আস্ত দুটি ডরমিক্যাম খেয়ে ঘুমের অপেক্ষা করছে। রাতের কামের এমনই নেশা ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুম আসে না। রাতে সিঁদকেটে অভ্যস্ত হাতের আঙ্গুলগুলো নিশপিশ করে। সূর্য ডুবে গেলেই বাহুর রক্ত সঞ্চালন দ্রুত বেড়ে যায়, শরীর বিছানায় থাকতেই চায় না। ছটফট করে গগন মিয়া। বুকের ভেতর থেকে গালি বের হয়, তারই একনিষ্ঠ সহকর্মী ধলুর উদ্দেশ্যে, হালার পুতে বিয়া কইরা সব ভুইলা গেল নাতো?
ধলুর উপর প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে গগন এক সময় বিকৃত ভঙ্গিমায় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘরের ঝাপ লাগাতেও ভুলে যায়। গভীর রাতে শোবার পুরনো চৌকির ঠকঠকানিতে গগন মিয়া ধড়ফড় করে উঠে বসে। হঠাৎ ভূমিকম্পের বিষয় নিয়ে চিন্তিত হবার সাথেসাথেই অতি পরিচিত কণ্ঠ খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে। গগন বুঝে ফেলে, এতো ধলুর হাসি। গগনের মন খারাপ ভাবটা ভাল হয়ে যায়।
গগনের ভাবেসাবে পরওয়ানেহী ধাচ। অলস হাতে হাঁটুর উপর উঠে আসা লুঙ্গি নিচের দিকে নামাতে নামাতে ধলু প্রশ্ন করে, কিরে এতো রাইতে কি মনে কইর্যা? ধলুর আচরনে আনন্দের বন্যা, আমার স্ত্রী দেখবি না?
গগনের মনটা হঠাৎ মেঘে ঢেকে যাবার মতো খারাপ হয়ে যায়। শালাতো দ্যাহা যায় স্ত্রী ইশেকে মশগুল, রাইতের বাণিজ্য রাইখা স্ত্রীর গল্প, লক্ষণ ভালনা, এদিকে পকেটের অবস্থা খুবই করুণ, আগামীকালের খোরাক ঘরে নাই। যারে দিয়ে এ বিদ্যায় হাতে খড়ি সে যদি বিয়ে করেই পেশা বদলে ফেলে, তা হলে নিজের উপায় চিন্তা করে গগন চুপষে যায়।
ধলু তাড়া দেয়, দোস্ত তাড়াতাড়ি চল, গগন শেষ পর্যন্ত রাজি হয়। কিন্তু খালি হাতে নতুন বউ দেখা বড়ই বেমানান। মন খারাপ হয়। বেচারী ভাবীকে অন্তত একটা শাড়ী দেওয়া দরকার, নিজের সম্মান বলে একটা বাক্য।
মাথায় হঠাৎ বুদ্ধিটা উদয় হয়, ধলুর বাড়ীতে যাবার পথে মাদবর চর হাট, হাটের উত্তরে সারিবাধা শাড়ী-কাপড়ের দোকান, যে কোন একটায় ঢুকে পড়তে হবে, আজ চুরি নয়, প্রয়োজন মতো মাত্র একটা শাড়ী … বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই সান্ত্বনায় মন ভরে যায়। অবশ্য বিষয়টা পুরোপুরি গোপন রেখে ধলুকে প্রশ্ন করে, কিরে বাসর কেমন করলি?
হারাম দোস্ত হারাম, কোন বাসর করি নাই, স্ত্রী দেখতেই আমি বেহুশ, বদ অভ্যাসটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠলো- ইচ্ছে হলো, স্ত্রীর সব গয়না চুরি করি, বোঝ আমার অবস্থা। দোস্ত তুই ক, আমার মতো এত বদ এই জাহানে দ্বিতীয় জন আছে? গগন ফিক্ করে হেসে ওঠে। সন্তুষ্ট চিত্তের হাসি, মনে ভরসা পায়। একমাত্র সাথী বিয়ে করে বদলে যায়নি। তবে ধলু নিজেকে বদ ভাবছে কেন, এ বিষয়টা ওর বুঝে আসে না। পরওয়ার দেগার একেক জনের কাজ একেক জায়গায় ঠিক করে দিয়েছেন, ধলু এবং গগন মিয়ার কর্ম দিয়েছেন চুরি। একটু নীচু স্তরের কাজ তবে চুরি করে না এমন ইনসান খুবই বিরল। দেশের মন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, শিল্পপতি, কে চুরি করে না? তবে কর্মটা গোপনে করতে হয়।
এ ভুবনে অনেক পেশাই আছে, যা গোপনে করতে হয়। এতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাবনা মাথায় আসায় গগন নিজের প্রতি সামান্য বিরক্ত হয়। বুদ্ধিজীবীদের মতো ফাউল ভাবনা ভাবার কি দরকার?
ধলুকে বিদায় দিয়ে গগন হাটের দিকে পা ফেলে। শ্রাবণ মাসের রাত, আকাশ থমথমে, যে কোন সময় বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি এলেই সোনায় সোহাগা। চুরির জন্য এমন বৃষ্টিমুখর পরিবেশ খুবই উপকারী।
প্রায় শেষ রাতে দামি এটা শাড়ী নিয়ে গগন ধলুর বাড়ীতে উদয় হয়। চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে নতুন বউ রাবেয়া জেগে ওঠে। তার স্বামী বন্ধুর এমন আন্তরিকতায় সে খুবই মুগ্ধ। ধলু তার বন্ধু গগনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় গদগদ এমন না হলে বন্ধু? তার স্ত্রীকে মুগ্ধ করার এ ঋণ সে ইহ-জীবনে শোধ করতে পারবে না বলেই তার বিশ্বাস। তারপরও একটা চেষ্টা রাখতে হবে বলে মনে মনে মুখিয়ে থাকে ধলু।
প্রায় মাসখানেক পর দৈবভাবে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। কাজ শেষ করে বের হবার সময় নিতান্ত থুথ্থুরে বুড়ো গগনকে ঝাপটে ধরে চোর চোর করে আকাশ ফাটায়। ধলু মহাবিরক্ত হয় গগনের আচরণে, গাধাটা নড়াচড়া না করে ধরা পড়ার আয়োজন করছে যেন। গগনকে ধমক লাগায়, পাটা মাঝা দে, তারাতারি কর। ধলুর কথায় গগনের মাথায় হঠাৎ করেই যেন নিজেকে বাঁচানোর তাগিদ অনুভুত হয়, কিন্তু চরম বোকার মতো সে বৃদ্ধের মাথায় হাতের শাবল দিয়ে আঘাত করে।
বৃদ্ধ আঘাতের টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গগন ধলু দু’জনে দৌড়ে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ততক্ষণে লোকজন ওদের ঘেরাও করে এবং দু’জনেই ধরা পড়ে। বিভিন্ন রকমের আদর আপ্যায়ন শুরু হয়ে যায়- সবরকম অপমান করার পর জনতা ওদের পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। গগনের কাপড় নষ্ট হওয়ায় একটা উপকার হলো। বিষ্ঠার দুর্গন্ধে পুলিশ তেমন মারধর না করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয় চুরির কেইস দিয়ে। চুরি করার কথা স্বীকার করায় দুজনের সাজা হয়ে যায়। গগনের বয়স এবং বিয়ের রাতের সেই সম্মানজনক উপহার, বউকে দেয়া শাড়ীর কথা ধলুর মনে পড়ে। গগনকে বুঝিয়ে এবং উকিলের সাথে পরামর্শ করে ধলু একাই ঐ চুরির দায়িত্ব স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়। একদম পাকা মিথ্যে কথা বলে বিষয়টাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়,স্যার ঐ রাইতে আমি একাই চুরি করতে যাই। বিচারক প্রশ্ন করে, গগন অত রাতে ঐ দিকে কেন গিয়েছিল?
ধলুর এবং উকিলের শিখিয়ে দেয়া কথা অনুযায়ী জবাব দেয় গগন
স্যার আমি মারফতি মানুষ, বিচার গান আমার পরান, একটা গান হুনেন
ওগো মোল্লাজী খালি হাতে মোনাজাতের দরকার কি
তারে দিলাও কি আর পাইলাও কি
খালি হাতে মোনাজাতের দরকার কি?
গানটা ক্যামন?
স্যার মারফত হইলো আসল জিনিস। শুধু কপাল ঠেকায়ে খালি হাতে দয়ালের দরবারে কিছু চাইলেই পাওয়া যাবে এ আশা দুরাশা। চোরতো আমরা সকলেই, আপনিও চোর আমিও চোর। আপনি কাজ চুরি করেন আমি ইবাদত চুরি করি, সে বিচারে আমি চোর, কিন্তু আপনি আমারে সাজা দেওনের কে?
বিচারক বিব্রত হয় এবং গগনকে পাগল ভেবে মুক্তি দেয়। জেল থেকে যেদিন গগন বের হয়, সেদিন ধলু গগনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদে, গগনও কেঁদে-কেটে একাকার, ধলু ওর সংসারের সমস্ত ভার গগনকে বুঝিয়ে দেয়। আমি কিছুদিনের মধ্যে জেলের ভেতরে ব্যবসা ফেঁদে ফেলবো, টাকা পয়সার কোন অভাব হবে না, আর বিশ্ব রোডের পাশে একটা দোকানঘর দেখ, আমি তোরে টাকা পয়সা দেব, ব্যবসা করবি, রাইতের কাম বাদ। ঐ কামে ইজ্জত নাই। জেলের ভেতরের ব্যবসা আমার নখদর্পণে, কোন চিন্তা নাই, দেখতে দেখতে আট বছর কেটে যাবে।
ধলুর মুখে স্বাভাবিক হাসি, গগন কাঁদতে কাঁদতে জেল থেকে বের হয়, বারবারই ধলুর প্রতি সম্মানে মন ফুলে ওঠে। কত বড়, কত বিশাল ধলুর হৃদয়! প্রায় তিন মাসের মাথায় ধলু গগনকে চল্লিশ হাজার টাকা দেয়। গগন এতো টাকা দেখে অবাক হয়, কিরে ধলু এতো টাকা কৈ পাইলি? ধলুর মুখে তৃপ্তির এবং অহংকারের চিকন হাসি, খুব কষ্ট করি মাথা খাটাই, যা দোকান চালু কর। তোর ভাবির বাজার সদাই কিনে দিস, ত্রিভুবনে আমারতো আপন কেউ নাই, তুই আমার ভাই। ধলুর চোখে পানি।
নয় মাস বিশ দিনের মাথায় ধলুর মেয়ে সন্তান হলো। ধলু শোনার পর থেকেই দেখার জন্য পাগল। আঁতুর ঘরের চল্লিশ দিন পর ধলুর স্ত্রী মেয়ে সন্তানটিকে নিয়ে ধলুর সাথে দেখা করতে আসে। বারশ টাকা খরচ করে বিশেষ কামরায় স্ত্রী-কন্যার সাথে দেখা কওে ধলু। কন্যাকে দেখার পর তার জেলের দিনগুলো খুব দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে।
এর দু’মাস পর হঠাৎ একটি খবরে ধলু খুবই বিচলিত বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। খবরটা তার শ্বশুড় বাড়ীর লোকরাই দিয়ে যায়। খবরের সারমর্ম ধলুকেই দোষি সাব্যস্ত করে। তোমারই জানের দোস্ত গগন তোমার স্ত্রীকে বিয়ে করেছে। তুমিইতো তাকে ব্যবসা ধরিয়ে দিয়েছো। এবার বোঝ তোমার প্রতিদানের মার্জিত পুরস্কার কতো ভয়াবহ! ধলুর প্রথমে বিশ্বাসই হয় না। গগন এতোটা বেঈমান কি করে হবে?
আর স্ত্রী!
তার উপরওতো অবিশ্বাস করা কঠিন।
এরপর আরও দু’মাস চলে গেল, কিন্তু স্ত্রী একবারও দেখা করতে আসে না। যে সপ্তায় সপ্তায় দেখা করতে আসতো, সে এখন দু’মাসেও একবার আসে না।
এর কিছুদিন পর অবশ্য তার স্ত্রী জেল গেটে দেখা করতে আসে। তবে ধলুর সাথে নয়, গগনের সাথে। গগন মুদি দোকানে ফেনসিডিল বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে হাতেনাতে ধরা পড়ে। ধলুর মুখ হাসির নহরে প্লাবিত হয়। দাঁতের মাঢ়ি শক্ত হয়ে ওঠে। চোখের নদীতে খুব অস্পষ্ট হয়ে আগুনের একটি কায়া ফুটে ওঠে। তার শুকনো গলা থেকে একটি শব্দ বের হয়- খুন! তার স্ত্রী এখন প্রায় জেলগেটে দেখা করতো আসে গগনের সাথে! কষ্টের চেয়ে অপমানের দহন ধলুর বুকের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
ভেতরের দহন ধলুর দেহের বাইরে ঠিকরে পড়ে। চোয়ালের মাংসে মেঘের মতো কালো আস্তরণ, কোটরাগত চোখে ফ্যাকাশে হতাশা। সে হতাশার মধ্যে আবার তীক্ষè ঘৃণা ও হিংসা, প্রতিশোধের দু’ধারী তলোয়ার ঝকমক করে। ঐ তলোয়ার কাউকে দ্বিখণ্ডিত না করে যেন বিশ্রম নেবে না।
ধলু ওর প্রতিশোধের তলোয়ারে স্ত্রীকে টুকরো টুকরো করে, কিন্তু কন্যাটি তার চিৎকার কওে ওঠে, সে স্ত্রীকে হত্যা করতে পারে না। গগনকে হত্যা করতে গেলে তার কন্যাটির মা না-না করে ওঠে। ধলু ফোঁস ফোঁস করতে করতে ঘুম থেকে জেগে ছটফট করে, অপ্রকৃতিস্থের মতো মাথা চুলকায়। একদিনেই মাথায় উকুন হয়েছে। চুলে ক্রমেই জট বেঁধে উঠছে।
ধলু ইদানীং খাবারে নেই, ঘুমানে নেই। চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে তাকিয়ে থাকে। গেইটে তার কোন দোস্ত আসে না, গগনের দোস্ত আসে গেইটে। তার জন্য পাকা আম, আনন্দ বেকারীর কেক নিয়ে রাবেয়া অপেক্ষা করে, যে কিনা গত তিন মাস আগেও ধলুর স্ত্রী ছিল, এখন সে ধলুর কেউ না, সে এখন ধলুর বন্ধু গগনের স্ত্রী অথচ ধলুর কন্যাতো এখনও রাবেয়ারই কোলে। অপ্রকৃতিস্থের মতো ধলু হাসতে থাকে। এরকম হাসাহাসির কারণেই ধলুকে পাগলখানায় স্থানান্তর করা হয়।
ধলু ইটের সুরকি দিয়ে পাকা মেঝেতে গগনের ছবি আঁকে। সে গগনের গলা কাটে, হাত কাটে। একা একা কান্না কওে, পুরোপুরি পাগলের মতো। ধলু একদিন সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যায়। কারাগার থেকে পাগলা গারদে নেবার সময় গেইটে রাবেয়ার সাথে ধলুর দেখা হয়।
রাবেয়া অপরাধীর দৃষ্টিতে ধলুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ধলুর কন্যা-সন্তান রাবেয়ার কোলে বসে পাগলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য! সম্পূর্ণ নিস্পৃহ হয়ে ধলু অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। এ পৃথিবীর দিকে তার দৃষ্টি নেই, চোখ যেন অস্বচ্ছ এক জোড়া পাথর।
অসুস্থ একজোড়া চোখ_আহসানুল ইসলাম

Recent Comments