বাণী বচনের সাথে আমরা দারুন ভাবে পরিচিত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আমরা বাণীকে জীবন চলার পথে দিকদর্শন নিসাবে মান্য করি। মহামানবদের আমরা অনুস্মরণ করতে চাই বলে তাদের বাণী আমরা সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি জীবনের প্রতি পদে পদে অনুস্মরণ করতে চাই। তবে কোন মনিষী বাণী নামে বাংলা ভাষায় কোন গ্রন্থ প্রনয়নের সন্ধান আমার জানা নেই। সে ক্ষেত্রে কবি সাহিত্যক শওকত আলমের ‘বাণী সমগ্র’ সাহিত্যে একটি নতুন ধারা। জীবনের বাঁকে বাঁকে পোঁড় খাওয়া এই কবি তার জ্ঞান ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে বাণী সমগ্র রচনা করে বাংলা সাহিত্য নতুন সাহিত্য ধারা তৈরী করেছেন।
কবি বন্ধু শওকত আলম সম্পর্কে যা জানি, তার বাণী পাঠ করলে মনে হবে তিনি জীবন থেকে ছেঁকে তুলে এনেছেন অভিজ্ঞতার, বাস্তবতা আর চিরন্তন সত্য মিথস্ক্রয়। নানা বিচিত্র চিরন্তন বাস্তবতা বাণীর আলোকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। যা তিনি নিজের জীবনে সত্য বলে জেনেছেন। তার বাণী পাঠ করলে কখনো মনে হবে তিনি ইসলামের একজন সাধক পুরুষ। তিনি একজন ধর্মগুরু।আবার কখনো মনে হবে তিনি একজন উচ্চমানের সমাজ কর্মী রাজনীতিবিদ। কখনো মনে হবে সৎ যোগ্য আমলদার। কখনো মনে হবে তিনি অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে আলোর সন্ধান পেয়েছেন। গভীর দর্শনবোধ পাওয়া যায় তার সমগ্র রচনায়। ব্যক্তি জীবনে কবি শওকত আলম এই বাণী সমগ্রের প্রতিটা বাণী লিখেছেন কবিতার ছন্দে অথবা অলংকার প্রয়োগ করে, কখনো বাণী লিখেছেন উপদেশের ছলে আবার কখনো আহবান অনুরোধে। কখনো রাষ্ট্র নায়কের মত বাণী তুলে ধরেছেন দেশের কল্যাণে। কখনো আবার তত্ত্ব দিয়েছেন সাধু সন্যাসীর মত।
এই বাণীর গভীরতা মহা সমুদ্রের বিশাল জল রাশির পরিধির মত বিস্তৃত্বপূর্ণ। যেন এ সুফিবাদের তত্ত্বের জঁপের মালা গাঁথা। প্রতিটা বাণী স্বর্গীয় সুধা মনি মুক্তার মত পাতায় পাতায় থরে থরে সাঁজানো। বাণীর সুরঝংকার মনকে আত্মাকে সংস্কৃতির আলোকছটায় সংস্কার ও আত্মশুদ্ধি হওয়ার মরমি আর বিপ্লবী প্রশিক্ষন দেয়। বাণী সমগ্র পড়লে গভীর জীবনবোধে পরিবর্তনের ছোয়া আজীবন মনের মাঝে দোলা দেবে। এ যেন একটি স্বর্গীয় ফুলের বাগান, নানান কথার বহুতত্বের বিচিত্র জ্ঞান ভান্ডার। আধ্যাত্মিক কবি শওকত আলম ভূমিকায় ব্যাক্ত করেছেন: “বাণীর আবেদন চন্দ্র, সূর্য্য, গ্রহ, নক্ষত্রের মতন তেজদীপ্ত আলোকচ্ছটা আর মনি মুক্তা স্বর্ণ অলংকারের মতন বাণী ভাষার উজ্জ্বল রত্ন ভান্ডার”। তাই বাণী চুম্বক শক্তির মত মানুষকে মহিত করে রাখে।
আবার সমকালীন নানান বিষয় আয়নার মত তুলে ধরেছেন। প্রথম ১৯ নং পর্যন্ত বাণী ইসলামের মহান বাণীরই প্রতিধ্বনি। যেমন তিনি বলেছেন “সেজদা করার পরও যার দম্ভ অহংকার কমে না বুঝবে সে ইবলিশের বন্ধু”। (বাণী ৩) আবার “দয়া, সিজদা, ক্ষমা ও দান সদা বৃদ্ধি করে সম্মান ” অথবা “পিতা মাতা বেঁচে থাকতে জান্নাত কিনে নাও, নইলে পৃথিবী ছেড়ে দাও”। এ যেন হাদিসেরই সমার্থক বাণী। সত্যের মাপ কাঠিতে চলার প্রতি কবির আকুল আবেদন বাণীর মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
জন্ম গত ভাবে পিতা মাতার আর.এন.এ, আর ডি.এন.এ মধ্য থেকে নতুন বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই সূত্র ধারা হয়ে পৃথিবীতে আসে নতুন সাথী। তাই কবির চেতনায় ঝংকার দোলখায়। কবি বলেন “জন্মচক্র, জলচক্র, চক্রঘোর, বায়ুচক্র ও শঙ্খমোড় এই পঞ্চমতত্ত্ব বিশ্লষণে ইহা তথ্যগত আদিজ্ঞান”। (বাণী ৬৮২নং)। আবার কবি বলেন-” এ্যাটোম বোম আর ইউরিনিয়ামের চেয়ে শক্তিশালী হলো কলম, ভাষা আর মানুষ”। অথবা “তোমার চোখের প্রতি পলোক যেন দাওয়াতী মিশনের সাক্ষ্য হয়”। অথবা “হে মানুষ ! দিব্য জ্ঞানীকে তোমরা বন্ধু হিসাবে গ্রহন করো, দিব্য জ্ঞানীকে নিজ দেহের অঙ্গের মতো মনে করো” বাণী (নং৬২৪ )। এই পৃথিবীতে মানুষ জন্ম গ্রহন করে আবার কিছুদিন বাদে আবার পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নেয়। চিরকাল কেহ এখানে থাকতে পারে না। যারা সৎ কর্ম সম্পাদন করে তারাই সৌভাগ্যশালী। তাই যারা সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখে না, তারা মৃত্যু বরণ করার সাথে সাথে তাদের নাম পৃথিবী থেকে মুছে যায়। তাই বাণীর মাধ্যমে কবি বলেন “তুমি যদি অমরত্ব লাভ করতে চাও, তবে দাতা হও, লেখক হও, সেবক হও”। আমরা একদম ভুলে গিয়েছি মুক্ত চিন্তা আর মুক্তির পথ, সেবার কর্মপরিধি। তাই কবি যোগ্যতা অনুসারে পৃথিবীতে পাটিষ্ঠানিক কর্মকাঠামো করে যাওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
রাষ্ট্র বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও আইনের ছাত্র-লেখক কবি শওকত আলম নানা বিষয় ভাবনার মধ্যে ভুলে যান না যে, তিনি এই সমাজ ও রাজনীতিরই বাসিন্দা। যেমন তিনি বলেছেন “অতি অত্যাচার যুগে যুগে বিপ্লবী রক্তবীজের জন্ম দেয়”। অথবা “জাতীয় জীবনে দীর্ঘশ্বাস বিপ্লবের জন্ম দেয়”। অথবা ‘রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘতম সূতিকা মহাবিপদ ডেকে আনে”। এসব সমসাময়িক রাজনীতিরই নিয়ামক।
রাজনীতি সমাজনীতি শিক্ষা সংসার ধর্ম বিজ্ঞান দর্শন সর্বক্ষেত্রে এই পৃথিবীতে প্রেম ভালবাসা মানুষকে স্বর্গ সভ্যতার ভূখন্ডে এক অনন্য সূঁতায় গেঁথে দেয়। নির্যাস প্রেম ভালবাসা মমতা ভিন্ন বাইরের জগতটা এক প্রকার অসভ্য নরকের রাজত্ব।কবি তার বাণীতে বলেন “হে প্রীতিময়ী! প্রেমে যদি ডুবতে হয় তাঁর প্রেমে মজো, মজা আছে। এই জগৎ ধারার প্রীতিময় মোহনায় স্বর্গসুধায় অন্তর চক্ষু খোলে” (৫০৭ নং বাণী )। আবার কবি বলেন “শরতের জ্যোৎস্না প্লাবিত নিশি জগতের স্বর্গীয় ফুলশয্যা” (৫৩২ নং বাণী )। আবার বাণী লেখক বলেন “শরতের রঙিন আকাশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পগুণের সমাহার আর তিনি শিল্পীকে শিল্পগুণ সম্পন্ন হতে শিক্ষা দেন” (৫৩৫ নং বাণী )। অথবা কবি বলেন “প্রেমের সার্থকতার উচ্চতর সিঁড়ি হলো এই পৃথিবীর জন্য কিছু সৃজনী স্মৃতি করে যাওয়া” (৫৭২ নং বাণী)। অথবা কবি বলেন “হে প্রহরী! এখন নিঝুম গভীর রজনী সামনের জান্নাতী সুঘ্রাণ; পিছনে নরকের উত্তাপ, তুমি পরিবর্তনের পোশাক পরো” (৫০৮ নং বাণী)। বা তিনি বলেন “হে আল্লামা ! এই জগতে সম্পদের মায়া মমতার মোহ ছাড়, পশু পাখির কীটপতঙ্গের মত রুজির চিন্তাও ছাড়, এক নিরাকার নীলের নহরে ডুব দাও, আর তুমি তাঁর পথে রঙ্গিন হও” (৫১০ নং বাণী) এ যেন কবির চোখে এক অলৌকিক প্রেমের বাঁশির সুরের মোহন খেলা। নিজেকে সুন্দর নিখুঁত মানুষের মত মানুষ হওয়ার আহবান।
আজীবন সংগ্রামী এই বাণী লেখক অন্ধকারে থেকে আলো খুঁজেছেন নিজের জন্য মানুষের জন্য। যেমন তিনি বলেছেন “পাপের মধ্যে মুক্তি নেই, প্রকৃত মুক্তি হলো ত্যাগে” (৮০ নং বাণী) অথবা “পাপ করার পরও যে আত্মার মধ্যে অনুশোচনা বোধ তৈরী হয়নি সে আত্মা আগুনের খোরাক” (১১৯ নং বাণী)।
সুফিবাদ নিয়ে গবেষণারত এই বাণী লেখকের লেখায় বাদ পড়েনি সুফি তত্ত্ব। তিনি বলেছেন “সুফিবাদের চৌকাঠ দরজা জানালা পার হতে হলে সর্ব প্রথমে নিজেকে চিনতে হবে”। “সুফি সাধকগণ পরস্পরের বন্ধু ও আত্মার পরম আত্মীয়”। তাই এক বাক্যে বলা যায় যে, লালন ফকির, সিরাজ শাই, হাসন রাজা হলেন সুফি ও সুফি তত্ত্ববাদের সংগীতের রাজা আর আধ্যাত্মিক কবি শওকত আলম হলেন, সুফিবাদ ও সুফিতত্ত্ববাদ সাহিত্যের রাজ্যের আকাশে এক অনন্য বাণীর সম্রাট।।
‘বাণী সমগ্র’ একটি দর্শন গ্রন্থের সমাহার। গ্রন্থটির প্রতিটি স্থরে স্থরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য তথ্যের ভান্ডার। “তুমি জ্যোতিময় সূর্য্য দেখেছ কিন্তু ছুয়ে দেখনি, তুমি মানুষ দেখেছ কিন্তু মানুষ চেনোনি”। অথবা “হে মানুষ তুমি মাটি হওয়ার আগে খাঁটি হও”। খাটি হওয়া মূল মন্ত্র হল দান, সেবা, সদকা, এবাদাত। তাঁর হক, বান্দার হক পালনের মধ্য থেকেই মুক্তির সোনালী সোপান।
কবি শওকত আলম ১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা – গাবুরা গ্রামের সরদার বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি তার পিতাকে হারান ১৯৮০ সালের ২ রা রমজান মাসে তখন কবি শিশু। মায়ের অতিস্নেহ আদরে তিনি বেড়ে উঠেন। বিগত ২০১২ সনের ২৬ ডিসেম্বর তার মাও মারা গেছেন। কবি মাকে প্রচন্ড ভালবাসতেন। মায়ের কদমমুছি ছাড়া তিনি বাড়ির বাহির হতেন না। তার মা অসুস্হ হলে তিনি দীর্ঘ দশটি বৎসর কোন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাননি। তার মা শয্যাশায়ী হলে তিনি শিয়রে থাকতেন এবং শীতের গভীর রজনীতে দূর থেকে কলের পানি আনতেন এবং গরম পানি ও দুধপান করাতেন। “মোমের মতো গলতে শেখো জ্বলতে শেখো সোনার প্রদীপ হও”। অথবা কবি বলেন “বন্ধু তোমার আয়নায় আমায় দেখ তুমি, দর্শনে দর্শন দাও, বন্ধু আমায় তুমি হও”। এই সমাজ সংসার নির্মাণের মধ্য থেকে মানবতার সেবা যেমন করতে হবে, তেমনি পিতা মাতা আত্মীয় স্বজন গুরুজনের সেবা করে যেতে হবে। সেই সঙ্গে আবার আমার মালিকের নিয়ম নীতি অক্ষরে অক্ষরে প্রতি পালন করতে হবে। তাহলে এই মানব জনম স্বার্থক হবে। সুতরাং জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দশ্য হতে হবে দুনিয়া ও আখেরাতে মুক্তি।
কবি শওকত আলমের অমূল্য এই বাণী গ্রন্থ জ্ঞানী ও জ্ঞান পিপাসু মানুষের যেমন তৃষ্ণা মিটাবে তেমনি যারা লেখালেখির পেশার কাজ করেন তাদের অমীয় সংগ্রহে রাখার মত একটি ‘অভিধান’ হিসেবে কাজে লাগবে এই “বাণী সমগ্র” গ্রন্থখানা।।
Recent Comments