ভাদ্রমাসের ভোর বেলা। স্বর্গের ঊষা মর্ত্ত্যে নামিয়া ঘরে এর শান্তি বিলাইতেছে; তাহার অমিয় কিরণে মেদিনী-গগন হেমাভবর্ণে আলোকিত হইয়াছে; উত্তরবঙ্গের নিম্ন সমতল গ্রামগুলি সোণার জলে ভাসিতেছে; কর্ম্মজগতে জাগরণের সাড়া পড়িয়াছে; ছোট বড় গজনী নৌকাগুলি ধবল-পাখা বিস্তার করিয়া গন্তব্যপথে ঊষা-যাত্রা করিয়াছে; পাখীকুল সুমধুরস্বরলহরী তুলিয়া জগৎপতির মঙ্গল-গানে তান তুলিয়াছে; ধর্ম্মশীল মুসলমানগণ প্রাভাতিক নামাজ অন্তে মসজিদ হইতে ফিরিতেছেন; হিন্দু-পল্লীর শঙ্খঘণ্টা-রোল থামিয়া গিয়াছে।
এই সময়ে মধুপুর গ্রামের একটি চতুর্দ্দশবর্ষীয়া বালিকা তাহাদের দ্বারে বসিয়া বন্যার জলে ওজু করিতেছিল। তাহার মুখ, হস্তদ্বয়ের অর্দ্ধ ও পদদ্বয়ের গুল্ফমাত্র অনাবৃত এবং সমস্ত দেহ কাল ইঞ্চিপেড়ে ধুতি কাপড়ে আবৃত। গায়ে লালফুলের কাল ডোরা ছিটে কোর্ত্তা। দুই হাতে ছয় গাছি চাঁদির চুড়ি। অযত্ন বিন্যস্ত সুদীর্ঘ কেশরাশি আল্গা-ভাবে খোপা বাঁধা। বালিকার মুখমণ্ডল বিষাদে ভরা!
বালিকা যে স্থানে বসিয়া ওজু করিতেছিল, তাহার সম্মুখ দিয়া উত্তর দক্ষিণে লম্বা অনতিবিস্তৃত খাল, দক্ষিণমুখে ঢালু, বারিরাশি দুকূল প্লাবিত করিয়া স্রোতোবেগে প্রবাহিত হইতেছে। পূর্ব্বপারে একখানি পানসি নৌকা পাটক্রয়ের নিম্ত্তি উত্তর দক্ষিণমুখে লাগান রহিয়াছে। একজন যুবক সেই নৌকার ছৈ মধ্যে বসিয়া স্বাভাবিক মধুর কণ্ঠে কোরাণ শরিফ পাঠ করিতেছেন। নৌকায় তিন জন মাঝি, এক জন যাচনদার, একজন পাচক ও যুবক স্বয়ং ছিলেন। যুবকের আদেশে যাচনদার মাঝিগণ পাটের সন্ধানে ভোরেই পাড়ার উপর নামিয়া পড়িয়াছে।
যুবক নৌকায় বসিয়া কোরাণ পাঠ করিতেছেন। যুবকের দেহের ও মুখের গঠন সুন্দর; নবোদ্ভিন্ন ঘনকৃষ্ণ-গুস্ফ-শ্মশ্রু তাঁহার স্বাভাবিক সৌন্দর্য আরো বাড়াইয়া তুলিয়াছে। যুবকের বয়স ত্রয়োবিংশ বৎসর। মাথায় রুমী টুপী, গায়ে সাদা সার্ট ও পরিধানে রেঙ্গুনের লুঙ্গী। এই সাধারণ পরিচ্ছদেও তাঁহাকে কোন আমিরের বংশধর বলিয়া বোধ হইতেছে।
বালিকা ওজু করিতেছে; কিন্তু সদ্য-ঘটনা-পরষ্পরার যুগপৎ ঘাত-প্রতিঘাতে তরঙ্গায়িত হৃদয়ের ভাব যেন তাহার মুখে ক্রীড়া করিতেছে। আবার এই অবস্থায়ও গাঢ় অন্ধকারময়ী রজনীতে নিবিড় জলদ-জাল মধ্যবর্ত্তী ক্ষণপ্রভাব বিকাশবৎ আশার একটী ক্ষীণোজ্জ্বলরেখা বালিকাকে যেন কোন এক সুধাময় শান্তিরাজ্যের পথ দেখাইয়া দিতেছে।
বালিকা নৌকার উপর কোরাণশরিফ পাঠ শুনিয়া মস্তকোত্তোলন করিল। সে মায়ের মুখে শুনিয়াছিল কোরাণের মত উত্তম জিনিস আর কিছু নাই, উহা যে পড়ে বা শুনে তাহার জন্য বেহেস্তের দ্বার উন্মুক্ত। বালিকার দাদিমাও সদাসর্ব্বদা বলেন, কোরাণশরিফ-রূপ শরাবন তহুরা পাঠে ও শ্রবণে মানুষের অন্তর্নিহিত অশান্তি-আগুন নিবিয়া যায়। বালিকা, জননী ও দাদিমার উপদেশ হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিয়াছে। সে প্রতিদিন প্রাতে কোরাণশরিফ পাঠ করে; আজও তজ্জন্য ওজু করিতে বসিয়াছে। কিন্তু নৌকার মধুবর্ষী স্বরে কোরাণপাঠ বালিকাকে আত্মহারা করিয়া তুলিল। সে ওজু ভুলিয়া গিয়া অনন্যচিত্তে কুরাণশরিফ পাঠ শুনিতে লাগিল।
যুবক কোরাণ পাঠ শেষ করিয়া দুই হাত তুলিয়া নিমীলিত-নেত্রে মোনাজাত করিতে লাগিলেন;-
দয়াময় তোমার পবিত্র নামে আরম্ভ করিতেছি। সমস্ত প্রশংসা তোমার। তুমি অনাদি অনন্ত, সর্ব্বজ্ঞ সর্ব্বশক্তিমান। তুমি ধৈর্য্য ও ক্ষমার আঁধার, তুমি অসীম করুণার উৎস। তুমি কোটী বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা ও ত্রাতা। সন্তান জন্মিবার পূর্ব্বেই তোমার দয়ায় মায়ের বুকে তাহার আহারের বন্দোবস্ত হইতেছে। করুণাময়! অগাধ সাগরের তলে, কঠিন পাথরের মধ্যে থাকিয়াও অতি ক্ষুদ্র কীটসকল তোমার কৃপায় আহার খাইয়া সানন্দে বিহার করিতেছে। তাই বলিতেছি, হে প্রভো! তোমা অপেক্ষা আর বড় কে? তোমার চেয়ে আর দয়ালু কে? বিভো! তুমি যে কি তাহা তুমিই জান, তোমাকে জানে বা বোঝে তোমার অনন্ত বিশ্বে এমন কে আছে? তা নাথ, তুমি যত বড় যেমনটি হও না কেন, আমাকে তুমি অবহেলা করিতে পার না, আমি তোমার আঠার হাজার আলমে শ্রেষ্ঠতম জীবমধ্যে একজন। আমার গ্রাসাচ্ছাদন তোমাকে জোগাইতে হইবে। আমার আকাক্সক্ষার বিষয়ও তোমাকে শুনিতে হইবে”।
“দীননাথ! দীনের প্রার্থনা, আমাদের ভব-সমুদ্রের কাণ্ডারী হজরত মোহাম্মদ (দঃ) যিনি তোমারই একত্বের পূর্ণপ্রচারক এবং তাঁহারই বংশধর মহাপুরুষেরা সমস্ত মানবজাতির জ্ঞানবর্ত্তিকা। অতএব, সর্ব্বাগ্রে তাঁহাদের পবিত্র আত্মার উপরে তোমার শুভাশীর্ব্বাদ বর্ষিত হউক। সমস্ত মুসলমান নর-নারীর সুখ-শান্তির নিমিত্ত তোমার র্বকতের দ্বার উন্মুক্ত করে দাও। তোমার দাসগন ঈমান-ধন হারাইয়া দ্রুতবেগে ধ্বংসের দিকে যাইতেছে, তুমি দয়া করিয়া তাহাদিগকে রক্ষা কর। নিজ গুণে ক্ষমা কর। তাহাদিগকে গুণবান্ কর। ভ্রাতৃভাবে প্রীতির পবিত্র-সূত্রে সমস্ত মানব জাতিকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হইতে মতি দাও; স্বর্গীয় শোভায় উদ্ভাসিত হউক।”
“অনাথনাথ! কৈশোরে মাতৃস্নেহে বঞ্চিত-যৌবনে হইয়াছি, এই- পিতৃশোকে সংসার অন্ধকার দেখিতেছি। প্রভো! তুমি সকলই জান দাস অকৃতদার, যদি গোলামকে সংসারী কর, তবে যেন প্রেমের পথে তোমাকে লাভ করিতে পারি। আমিন”।
যুবক বহির্জ্জগৎ ভুলিয়া একাগ্রমনে মোনাজাত করিতেছিলেন। তন্ময় চিত্ততায় তাঁহার পবিত্র হৃদয়োদ্ভূত ভক্তিবারি নয়নপ্রান্ত বহিয়া গণ্ডস্থল প্লাবিত করিতেছিল। বালিকা কোরাণশরিফ, মেফ্তাহল জিন্নাত, রাহেনাজাত, পান্দেনামা গোলেস্তাঁ প্রভৃতি আরবী, পারসী ও উর্দ্দু কেতাব তাহার দাদিমার নিকট শিক্ষা করিয়াছিল। মোনাজাত আরবী-মিশ্রিত উর্দ্দুতে উচ্চারিত হইতেছিল, সুতরাং সে তাহার অর্থ অনেকাংশে বুঝিতে পারিতেছিল। বুঝিয়া-শুনিয়া বালিকার চক্ষুও অশ্র“পূর্ণ হইয়া উঠিল। সে অসহ্য-মনোবেদনা ভুলিয়া চিন্তা করিতে লাগিল,- “আহা, আজ কি শুনিলাম! এমন খোস-এলহানে কোরাণশরিফ পাঠ ত কখন শুনি নাই, এমন মধুর উচ্চারণও ত কখন শ্র“তিগোচর হয় নাই! কি মধুমাখা মোনাজাত! এমন সুন্দর মোনাজাত ত কখন শুনি নাই। বুঝিবা কোন ফেরেস্তা মানবমূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া মধুপুরে আসিয়াছেন, নচেৎ এমন বিশ্বপ্রেমভরা মোনাজাত কি মানবমুখে উচ্চারিত হইতে পারে? মোনাজাতে যেন হৃদয়ের ভাব ফুটিয়া ফুটিয়া বাহির হইয়াছে।” এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যখন “দাস অবিবাহিত, যদি গোলামকে সংসারী কর, তবে যেন প্রেমের পথে তোমাকে লাভ করিতে পারি।” যুবকের মোনাজাতের এই শেষ কথা কয়টি বালিকার মনে পড়িল, তখন সহসা অলক্ষিতে তাহার গোলাপ-গণ্ড রক্তিমাভ হইয়া উঠিল, স্বেদবারিবিন্দু মুখমণ্ডলে ফুটিয়া বাহির হইতে লাগিল। পাঠক, সোণার গাছে মুক্তাফল বুঝি এইরূপেই ফলে। বালিকা এক্ষণে সেই দূর ভবিষ্যৎ আশার আলোকে আপনাকে ডুবাইয়া দিয়া অস্ফুটস্বরে বলিয়া উঠিল,- “তবে ইনিই কি- তিনি?”
আনোয়ারা_মোহাম্মদ নজিবর রহমান : প্রথম পরিচ্ছেদ

Recent Comments