দুবাই চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি করা কালে আমি প্রতি বছর এক মাসের ছুটি পেতাম। ছুটির সাথে অফিস থেকে আমাকে ও আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের ঢাকা পর্যন্ত যাতায়াতের টিকেট দেয়া হতো। ছুটিতে আমি প্রতি বছর বাংলাদেশে আসতাম। বাংলাদেশ থেকে আবার কখনো নেপাল, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুর গিয়েছি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। ইতঃমধ্যে ১৯৮১ সনে এককভাবে এবং পরবর্তীতে ১৯৯০ সনে সপরিবারে সৌদি আরবে গিয়েছি হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে। ১৯৮৪ সনে জুলাই মাসে ছুটি পেয়ে আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদেরকে ঢাকা পাঠিয়ে আমি আমার টিকেট নিলাম দুবাই-লন্ডন-দুবাই রুটে। লন্ডনসহ ইউরোপের দশটি দেশ সড়ক পথে ভ্রমণের সিন্ধান্ত নিয়ে অফিসের মাধ্যমে উক্ত দশটি দেশের ভিসা সংগ্রহ করে নিলাম। এ ব্যাপারে আমাকে কোন রূপ ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়নি।
প্রোগ্রাম অনুযায়ী আমি ১ জুলাই দুবাই এয়ারপোর্টে গেলাম রাত তিনটায়। সকাল পাঁচটায় শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের বৃহদাকার এয়ারবাসে চড়ে আমার রওয়ানা হওয়ার কথা। কিন্তু কেলা থেকে দুবাই আসতে এয়ারবাসের দু’ঘন্টা বিলম্ব হলো। নির্ঘুম সারাটি রাত কাটলো আমার এয়ারপোর্টে। প্রতীক্ষার প্রহর গণনার মতো অসহ্য আর কিছুই নেই। কিন্তু বাধ্য হয়েই মাঝে-মধ্যে তা করতে হয় সকলকেই। এয়ারপোর্টেই ফজরের নামায পড়লাম, তারপর ভোর সাতটায় গিয়ে এয়ারবাসে উঠে আমার নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করলাম। বৃহৎ এয়ারবাস। প্রায় সাড়ে তিন’শ যাত্রী। কিন্তু আমার পরিচিত কেউ নেই। এমন অপরিচিত পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা, অজানা বিভূঁইয়ে পাড়ি জমানো অস্বস্তিকর মনে হলো। যত পথ অতিক্রম করতে লাগলাম ততই এ অস্বস্তি বাড়তে লাগলো।
প্লেনে ওঠার কিছুক্ষণ পর নাস্তা দেওয়া হলো। নাস্তার পর দেওয়া হলো কোল্ড ড্রিঙ্কস। এরপর দীর্ঘ আট ঘন্টা আকাশ-পথে যাত্রা শেষে প্যারিস বিমান বন্দরে উপনীত হলাম। সেখানে এক ঘন্টা যাত্রা-বিরতি। তারপর আবার আকাশ-পথে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণের পালা। ঘন্টাখানেক ভ্রমণের পর প্লেন পৌঁছালো লন্ডন বিমান বন্দরে। এ দীর্ঘ যাত্রা-পথে আর কোন খাবার পরিবেশন করা হলো না। তবে যে যত খুশি বিয়ার চাওয়া মাত্র পেতে থাকলো। আমি বিয়ার খাই না, হারাম মনে করি। তাই আমার জন্য একমাত্র বিকল্প ছিল কোল্ড ড্রিঙ্কস। সেটা আর কতই খাওয়া যায়! উপরন্তু ডায়াবেটিক পেসেন্ট। তাই কোল্ড ড্রিঙ্কসও আমার জন্য নিষিদ্ধ। এছাড়া, সাধারণ পানিও সেখানে পাওয়া গেল না। আমি তাই ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়লাম। চারদিকে সকলে বিয়ার ও মদ নিয়ে অস্বাভাবিক মাতামাতি শুরু করেছে। এসব দেখে মন আরো অস্থির হয়ে উঠলো, কিন্তু করার কিছুই ছিল না। তাই অসহায়ের মতো ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করে নীরবে সারাটা পথ পাড়ি দিয়ে যখন লন্ডন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম, তখন আমি রীতিমতো ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত। আগে জানলে দুবাই থেকে আমি কিছু খাবার সঙ্গে নিয়ে আসতাম। কিন্তু বিষয়টি আমার জানা ছিল না বলে কষ্ট করতে হলো।
এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের কাজ সারতে দেরী হলো না। আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করা হলো, সাথে মদের বোতল কয়টি আছে? জবাবে আমি বললাম, একটিও না, আমি মদ খাই না। এরপর জিজ্ঞেস করলো অন্য কোন নিষিদ্ধ বস্তু সাথে আছে কি ? অর্থাৎ ড্রাগ জাতীয় কিছু। আমি বললাম, না। আমাকে তারা বিশ্বাস করলো। সম্ভবত আমার বলার মধ্যে যে অসংকোচ ভাব ও দৃঢ়তা ছিল তা দেখেই তারা আমাকে সহজে বিশ্বাস করেছে। তাছাড়া, শুনেছি, অনেক সময় চোখ-মুখের অবস্থা দেখেও তারা নাকি বুঝতে পারে। এরপর আমার পাসপোর্ট দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো ঃ কত দিনের ভিসা চাই? আমি বললাম এক সপ্তাহ হলেই চলবে। তারা আমার পাসপোর্টে একমাসের ভিসার সীল মেরে আমাকে বিদায় করলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ঐ সময় কমনওয়েলথভুক্ত দেশের নাগরিকদেরকে লন্ডনে প্রবেশের সময়ই ভিসা দেওয়ার নিয়ম ছিল। এখনকার মতো আগে থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে হতো না।
আমার দীর্ঘদিনের পুরানো বন্ধু হাফেজ মাওলানা নেছারউদ্দীন আহমদকে আগেই টেলিফোনে বলে রেখেছিলাম। তিনি আমাকে রিসিভ করতে এলেন এয়ারপোর্টে। তার দেখা পেয়ে আমি আনন্দ-পুলকে অভিভূত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি আমাকে নিয়ে এয়ারপোর্টের পাশেই রেল-স্টেশনে গেলেন। আমরা সেখানে গিয়ে অপেক্ষমান ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন থেকে নেমে আমরা গেলাম হাফেজ নেছারউদ্দীনের কর্মস্থল ৭৫ ফলকন রোডস্থ ইসলামিক সেন্টারে। এটি দক্ষিণ লন্ডনে অবস্থিত।
হাফেজ নেছারউদ্দীন নোয়াখালীর অধিবাসী। ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাশ করেন। ছ্ত্রা হিসাবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী। বাংলাদেশী ছাত্রদের প্রথম ব্যাচেই তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে তিনি দ্বীনের দা’য়ী হিসাবে সৌদী আরবের পক্ষ থেকে লন্ডনে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। লন্ডনে তিনি তিন তলা বিশিষ্ট একটি গীর্জা ক্রয় করে সেখানে প্রয়োজনীয় গড়াপেটার কাজ করে একটি মসজিদ ও দ্বীনী শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা গড়ে তোলেন। সাধারণত সপ্তাহান্তে এখানে মুসলিম ছেলেমেয়েরা এসে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করে। বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলা শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। আমাকে সেখানে একটি রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো। কয়েকজন বাংলাদেশী শিক্ষক-কর্মচারী সেখানে কর্মরত ছিলেন। তারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। আমিও বিদেশ-বিভূঁইয়ে তাদের পেয়ে খুশি হলাম। আমি যখন সেখানে পৌঁছলাম তখন সেখানে দুপুর মাত্র বারোটা। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে খাওয়া-দাওয়া করলাম। তারপর যোহরের নামায পড়ে একাই বেড়াতে বের হলাম।
তখন জুলাই মাস। ঐ সময়ে আমাদের দেশে তো প্রচন্ড গরম। ওদেশেও পঞ্জিকার হিসাবে গরমের মৌসুম। তাই আমি হালকা পোষাকেই রাস্তায় বের হলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখি প্রচন্ড শীত। আমি শীতে কাঁপতে লাগলাম। এর আগেও শুনেছি, লন্ডনে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে মুহূর্তের মধ্যে। সেখানে কথায় বলে, ‘মেয়েদেরকে এবং আবহাওয়াকে নাকি বিশ্বাস করা যায় না’। লন্ডনে এসেই আমি এ প্রবচনের দ্বিতীয় অংশটি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। অতএব, দেরী না করে এবাউটটার্ন করে আমি আমার রুমে ফিরে গেলাম। তারপর রীতিমতো গরম কাপড়ে নিজেকে আপদমস্তক আবৃত করে আবার রাস্তায় বের হলাম।
হাফেজ নেছারউদ্দীনের ছোট ভাই হাফেজ মুনীরউদ্দীন আহমদও তখন লন্ডনে থাকতো। আমি যখন দৈনিক সংগ্রামে সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে কাজ করি (জানুয়ারি ১৯৭০-ডিসেম্বর ১৯৭১), তখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের ছাত্র। দৈনিক সংগ্রামে সে তখন এপ্রেন্টিস হিসাবে কাজ করতো। সে হিসাবে তার সাথে আমার পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি তার অভিভাবকের মতো ছিলাম এবং তাকে যথোচিত সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। সেও ছিল আমার গুণমুগ্ধ। অনেক সুখ-দুঃখের কথা বলে সে তার মন হালকা করতো এবং আমার কাছ থেকে নানারূপ পরামর্শ চাইতো। আমিও সাগ্রহে তাকে নানারূপ পরামর্শ দিতাম।
আমার থাকার জায়গা থেকে তার বাসার দূরত্ব বেশী ছিল না। সেও দক্ষিণ লন্ডনে ৩৭ কান্দাহার রোডে সপরিবারে বসবাস করতো। আমি হাঁটতে হাঁটতেই টেলিফোনে দেওয়া তার নির্দেশ মতো তার বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। সে তখন বাসায়ই ছিল। সেখানে গিয়ে আমার এক পরিচিত বন্ধুকেও পেয়ে গেলাম। তার নাম তোজাম্মেল হোসেন। আগে তিনি তেজগাঁ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে ইনস্ট্রাকটর হিসাবে কাজ করতেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনে এসেছেন ডক্টরেট করার জন্য। তিনি প্রায়ই আসতেন দৈনিক সংগ্রামে লেখা দিতে। লেখালেখিতে তার উৎসাহ প্রচন্ড। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি লেখালেখি করেন। সে হিসাবেই আমার সাথে তার পরিচয়। পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেন। ২০১০ সনে তিনি ঢাকা ইন্তিকাল করেন। তাকে সেখানে পেয়ে খুব ভাল লাগলো। অনেকক্ষণ কথাবার্তা হলো। হাফেজ মুনীর উদ্দীনের সন্তানাদির সাথেও দেখা হলো। সবাই মিলে এক সঙ্গে চা-নাস্তা খেয়ে এরপর বিদায় নিয়ে রুমে ফিরে এলাম।
লন্ডনে প্রথমদিন আমার এভাবেই কাটলো। তবে একটা জিনিস দেখে আমি খুব অবাক হলাম, তা এই যে, সেখানে মাগরিবের নামাযের সময় হলো স্থানীয় সময় রাত্রি প্রায় দশটায়। এর দেড় ঘন্টা পর অর্থাৎ রাত সাড়ে এগারটায় এশার নামাযের ওয়াক্ত। প্রায় সারাদিন ভ্রমণের কারণে খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই মুসাফির হিসাবে মাগরিব ও এশার নামায একসঙ্গে আদায় করে রাতের খানা খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। ছোটবেলা থেকে যে লন্ডনের স্বপ্ন দেখে এসেছি, সে লন্ডনে সত্যি সত্যি আসতে পারায় মনে গভীর আনন্দ। অতএব, আনন্দের অনুভূতি নিয়েই গভীর ঘুমে রাত কেটে গেল।
আমার প্রথম ইউরোপ সফর_মুহম্মদ মতিউর রহমান : পর্ব-১

Recent Comments