আবহামান বাঙালির সভ্যতা সংস্কৃতির ইতিহাস সুপ্রাচীন। কারা এই সভ্যতার রূপকার? এ প্রশ্নের এখনো মিমাংসা করা না গেলেও প্রমাণ হয় যে এখনে হাজার হাজার বছর আগে বসতি ছিল। আজ বাংলাদেশ, বঙ্গভূমি, বাঙালি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয় তার ধারণা সেকালে ছিলনা। এ ধারণা গুলি গড়ে উঠেছে অনেক পরে, খ্রিষ্টের জন্মেরও পরে। প্রাচীন কালে যে সব নাম গুলি পাওয়া যায় তা হলে- বঙ্গ, গৌড়, সমতট, হরিকেল,পুন্ড্র,রায়, বরেন্দ্র, গঙ্গাহৃডি প্রভৃতি নাম। আজকের যে বঙ্গদেশ (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সমেত) তা এককালে নানা জনপদে বিভক্ত ছিল। বঙ্গ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় ‘রামায়ণ,মহাভরত, হেমচন্দ্রের অভিধান চিন্তামনি প্রবৃতি গ্রন্থে। পলি সাহিত্যের বহু স্থানে বঙ্গ নামটির উল্লেখ আছে। বঙ্গভূমি নানা জনপদে বিভক্ত ছিল। বিভিন্ন জনপদ বিভিন্ন নামে গড়ে উঠে। পাঠান আমলে বিভিন্ন জনপদের মধ্যে ঐক্যপ্রয়াসের ঘটনা ঘটে। মোঘল যুগে তা বি¯তৃতি লাভ করে। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সর্বপ্রথম বাংলা শব্দটি গোটা দেশের নাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থে দেশের নাম সুবা বাংলাহ্ বলা হয়েছে। ইউরোপের পর্যটকরা বিশেষ করে পুর্তুগীজরা দেশকে অভিহিত করেছে বাংলা নামে। লর্ড কার্জনের সময়ে ইষ্ট বেঙ্গল কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে পূর্ব বঙ্গ বা বাংলা আর ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশ নামটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে পাক-ভারত উপমহাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক গঠন অনুসারে ভারত বর্ষের তৎকালিন বাংলা অঞ্চলের প্রশাসন যন্ত্র পরিচালিত হয়েছিল যেমন- পাল, সেন রাজন্যবর্গ দ্বারা তেমনই সুলতান ও নবাবরাও এই বাংলাকে শাসন করেছিল একক কর্তৃত্বে। নিম্ন হিন্দুরা যেমন শোষিত হয়েছে, তেমনই শোষিত হয়েছে মুসলমানেরাও। যেহেতু ওসই সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা ছিল পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠির একাংশ। একই সঙ্গে এটাও লক্ষণীয় যে, এই অঞ্চলের হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় ও সামাজিক চিন্তার ছিল ব্যবধান অনেক। ফলে সামাজিক ভাবে এই দুই সম্প্রদায়ের ভিতরে যতখানি পারস্পরিক লেনদেন হবার কথা ছিল, তা কখনও হয়ে উঠে নি। হিন্দু মুসলমানের এই সামাজিক ব্যবধান শুরু৩থেকেই ধর্মীয় রাজনীতির অস্বাস্তকর চেতনার বীজ উভয়ের মস্তিস্কে বপন করে। যা ইংরেজদের আর্বিভাবের পূর্বেই সূচীত হয়। পরবর্তী কালে ইংরেজরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রয়োজনে উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবধানকে সক্রিয় প্রচেষ্টায় পরিণত করছে রাজনৈতিক বিরোধে। এই নপরিনতির নামই সাম্প্রদায়িকতা। ইংরেজরা ভারতবর্ষে জীবন যাত্রার যে নতুন আয়োজন করল তাতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলে কিন্তু এগিয়ে এলো না। নতুন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব হলো অনেকখানি। ইংরেজরা তাদের পূর্ববর্তী হিসেব অনুযায়ী হিন্দু এবং মুসলমানদের সুনজরে দেখলো না। উপর তলার মুসলমান সমাজে তাই দেখা দিল ক্ষয়ুষ্ণুতার লক্ষণ। তারা বন্দী হলো পশ্চাদপদতার নাগপাশে। আর হিন্দুরা খুঁজে পেল নিজদের খাপ খাইয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিল, মুসলমান তা পারে নি। রিজনৈতিক পারজয়ের গ্লানি ওতি বাঙালি মুসলমানকে যে ভাবে বিধস্থ করেছে, সমগ্র ভাররত বর্ষের অন্য কোথাও তা হয় নি। ইংরেজ পূর্ব যুগে ভারত বর্ষে শ্রম বিভাগ ছিল শ্রম নির্ভর। ইংরেজরা এ দেশের ধনতন্ত্রের বীজ বপন করে শ্রম বিভাগ করল জন্ম নিরেপেক্ষ। হিন্দু মদ্যবিত্ত সমাজ নিজকে ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি ও শক্ষাদ্ভিায় প্রতিষ্ঠিত করল এবং মুসলমানদের পিছিয়ে রেখে অনেকখানি এগিয়ে গেল। সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে হিন্দু মসলমানের মধ্যে পার্থক্যের যে চেতনা বিদ্যমান ছিল সে চেতনা ভারতীয় ধনতন্ত্র এবং মধ্যবিত্ত শ্যেনীর প্রসার অগ্রগতির সাথে ভরতীয় রাজনৈতিক জীবন ক্ষেত্তে সৃষ্টি করল এক কুৎসতি জটিলতা। এই জটিলতার নামই সাম্প্রদায়িকতা সাম্পাদায়িক সম্প্রিতিহীন মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে ব্যবসা বানিজ্যে ও চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল শুরু থেকেই। আবার হিন্দু সম্পদায়ের অেৈক্যর ফলে সরাসরি প্রতিযোগিতায় মুসলমানেরা দ্রুত উন্নতির ভরসাও পেল না। ১৭৫৭ সালে সিরাজের পতন এ দেশের গতানুগতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক রাজার প্রস্থান ও অন্য রাজার অনুপ্রবেশই নির্দেশ করে নি, এতে এ উপমহাদেশের ইতিহাসের হাজার বছরের অতীত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবন পদ্ধতির একটা ব্যপক পরিবর্তন সূচীত হয়েছে। শস্য-শ্যামল এ সোনার বাংলাকে তখন বলা হতো স্বর্ণ প্রসবণী। এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংষ্কৃতির ভান্ডার ও ছিল বিত্ত-বৈভবে পরিপূর্ণ। ব”হত্তর বাংলার মতো এত বড় দেশ হাতে পাওয়ায় অর্থলোলুপ বেনিয়া কোম্পানীর লোকদের লোভের ও শোষনের মাত্রা আরও বেড়ে উঠে। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হয়ে উঠে বর্ণনাতীত। কুখ্যাত ছিযাত্তরের মন্বন্তর এ সময়েরই ফল। বাকিম চন্দ্রের আনন্দ মঠে এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কলকময় ইতিহাস সৃষ্টির মাধ্যমে ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে রাজশক্তি ছিনিয়ে নেয়। পরিপ্রেক্ষিতে শতাব্দি কালেরও বেশি সময় ধরে মুসলমানরাও যেমন ইংরেজদের সুনজরে দেখতে পারে নি, ইংরেজরাও তেমনি মুসলমানদের দেখছে সংশয়, সন্দেহ ও অত্যারের দৃষ্টি ভঙ্গিতে। নজরুল তীতুমিরের ইংরেজ বিদ্বেষ ও তাদের উপর নির্যাতন-জুলুম তার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এ কথা সত্যি যে কোন দেশের রাজশক্তি যত বড় হওক না কেন কোন শাসিত দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন ও আনুকল্য ব্যতিত তা দীর্ঘকাল ঠিকে থাকতে পারে না। মুসলমান এবং ইংরেজদের মধ্যে যখন দ্বনাদ সংশয় সম্পর্ক বিরাজমান তখন নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য এ দেশের হিন্দু সমপ্রদায়কে হাত করার এবং তাদের চিত্ত জয় করার সাধনা চালালো ইংরেজ হঠকারীরা। একে মুসলমানেরা হারালো রাজশক্তি। তদুপরি এ দেশের শাসন ব্যবস্থা হাতে পাওয়ার পরপরই এ দেশে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত এবং আর্থিক উন্নতি সাধনের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পনীর লোকেরা যে কয়টি বৈপবিক সংস্কার সাধন করেছিল তার সব কয়টি গিয়েছিল মুসলমানদের স্বার্থের । প্রতিকূলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর প্রবর্তন ও নিষ্কর জমির বাজেয়াপ্তির পর দেখা গেল জমির মালিক মুসলমানরা হল নিঃস্ব এবং প্রজা ও মুসলমান ভূম্যাধিকারীর মধ্যবর্তী তহশিলদার, নায়েব, মুহুরী ও গোমস্তা প্রমুখ হিন্দু কর্মচারী ইংরেজদের অনুগ্রহে অত্যন্ত অল্প কালের মধ্যে হয়ে উঠল ভূস্বামী। এদিকে পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত রাজধানী মুর্শিদাবাদই ছিল সমগ্র বাংলাদেশের সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র। যার অনেকটাই ছিল মুসলমানদের জন্য অনুকূলে। রাজশক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক জীবন নিঃশেষিত হয়ে নতুন গড়ে উঠা রাজধানী সলকাতায় নতুন সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত হয়। মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রিক এতকালের সাংস্কৃতিক জীবনে মুসলমানদের যে প্রাধান্য এর রইল না। রাজ আনুকূল্যে হিন্দু সংস্কৃুতর প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকল এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র আচার অনুষ্ঠানগুলিতে অত্যন্ত সূক্ষ ভাবে হিন্দু ধারার রীতি-নীতির অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকল এবং অনেকটা হিন্দু আদলে আচার অনুষ্ঠানগুলি পালিত হতে থাকল। যদিও এর জন্য মুসলমানদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সুদৃঢ় প্রসারতার অভাব, অসচ্ছ মনোভাব এবং অপব্যাখ্যাই বেশির ক্ষেত্রেদায়ী।মুসলমানদের সামাজিক পর্বগুলির মধ্যে ইসলাম ধর্মের একটি সংযম ও শালিনতার দৃঢ় বন্ধন আছে বৈকি। তথাপি মুহররমের জাঁকজমকজাত যে উল্লাস তা হিন্দু পূজোপার্বণগুলির অনেকটা অনুসরণ। এ ছাড়া এর তাজিয়া নির্মাণ এবং দশম দিবসে মঞ্জিল মাটি তাও দূর্গা পূজার প্রতিমা গঠন ও দশমির দিনে বিসর্জনের মতো। হিন্দুদের গুরু পূজা মুসলমানদের পীর পূজা, পীরের দরগায় র্উস এবং ওলী-আওলিয়াদের মাজারে অতিরিক্ত জিয়ারত উপলক্ষে শেষ পর্যন্ত সেগুলোকে হিন্দুদের তীর্থ স্থানের মতো করে তোলা, বাংলাদেশে অশিক্ষিত ও গ্রাম্য মুসলমান সমাজে হিন্দুদের পৌরানিক সমুদ্র দেবতার মতো খোয়াজ খিজিরকে মেনে চলা, তাঁকে লক্ষ্য করে ফাতেহা পড়ে হিন্দুদের পূর্ব পুরুষদের নামে স্মৃতি-তর্পনের নদীতে পয়সা- মিষ্টান্ন তর্পণ করা, হিংস্র বন্য পশুদের উপড়ে ও পীরের মাহাত্ম ও স্বীকার করে পীরের সাহায্যে হিংস্র পশুদের শান্ত রাখা এবং তাদের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আত্মপ্রসাদ প্রভৃতি রীতি- নীতি ভারতীয় ইসলামে তথা বাঙালি মুসলিম সমাজ জীবনে হিন্দু প্রভাবজাত সুন্দর বন অঞ্চলে মুসলমানদের এক রকম পীর ছিলেন জিন্দাহ্ গাজী বা কালু গাজী। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মাঝে মুসলমানদের এই কালু রায় নামে পরিচিত। কলেরা ও বস ন্তের কু-গ্রহ থেকে বাঁচার জন্য নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মতো মুসলমানরাও একই কায়দায় শীতলা দেবী ও ওলা বিবির নামে প্রসাদ শিরনি দেওয়ায় বিশ্বাস করত। মধ্য যুগের বাংলার কবি সাহিত্যিকদের বহু রচনায় এসবের সমর্থন পাওয়া যায়। তাছাড়া মুসলমানদের বিবাহে পণ প্রথা প্রবর্তন এবং টাকা পয়সা আদান-প্রদান হিন্দু সমাজের অনুকর। বাংলা তথা ভারতীয় ইসলামে ও মুসলিম সমাজে এ ধরনের হিন্দু প্রভাব মুনলিম আমল থেকেই অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল। মুসলমানদের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা খসে গেলে শিক্ষা ও তবলিগের অব্যবস্থার ফলে তাদের মধ্যে এ অন্ধ মানসিকতা এবং কুসংস্কারের দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। কালের প্রবাহে, চেতনার সঠিক টানে সমাজ ও জাতীয় জীবনে এহেন অইসলাম বা হিন্দু প্রভাব প্রশ্রয় পাওয়াকেই মুসলমানরা তাদের সমস্ত ভাগ্যহীনতার কারণ বলে নির্দেশ করে তাঁদের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হযরত মুহম্মদ (সঃ) ও খালাফায়ে রাশেদীনের আমলের সর্ববিধ বেদাত ও শেরেক মুক্ত ইদিম ও অকৃত্রিম ইসলামের পূনঃপ্রর্বতনই যে তার একমাত্র উপায় এ বিশ্বাস থেকেই তখন বাংলার মুসলমানেরা তাদের ধর্ম সংস্কারের দিকে মন দেয়। সে থেকে নানাহ চড়ায়-উতরায় পেরিয়ে অসংখ্য মত পার্থক্য ও ক্ষীণ দৃষ্টি ভঙ্গির কারণ, নানাহ ক্রটি-বিচ্যুতির মধ্য দিয়েও সে ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।
ইংরেজ শাসনের একচোখা দৃষ্টি ও এ দেশের মুসলমান সংস্কৃতিতে হিন্দু সংস্কৃতির সংমিশ্রণ_আমির হোসেন

Recent Comments