মুনশী মোহাম্মদ মেহের উল্লাহর জন্ম হয় বাঙলার ইতিহাসে বড় মোড় পরিবর্তনের সময়। মাত্র একশ বছরের পরিবর্তনের ধাক্কায় বাঙলার সমাজ ও সংস্কৃতি তখন পুরা বদলে গিয়েছিল। একশ বছর আগের অবস্থাপন্ন মুসলিম সমাজ দ্রুত ও ব্যাপক পরিবর্তনের ধাক্কায় দারিদ্রের একেবারে তলায় পৌছেছিল। মেহের উল্লাহর অবদান বোঝার জন্য সেই পরিবর্তনের কারণ আর তার প্রবাহ উপলব্ধী করা প্রয়োজন। বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজ-সংস্কৃতি-স্বাধীনতার হেফাজতের জন্যও সে ব্যাপারে সচেতনতা থাকা জরুরি।
জোব চার্ণকের নাও ভিড়লো কৃষ্ণরায়ের কলকাতায়
১৭৫৭ সালে পলাশী প্রহসনের মধ্য দিয়ে নওয়াব সিরাজ-উদ-দৌলাহর পতনের সাথে সাথে বাঙলার ক্ষমতার আসল নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামক ইয়োরোপীয় খৃস্টান বনিক কোম্পানির হাতে। কোম্পানির লোকেরা ১৬০০ সাল থেকে এদেশের মাটিতে পা রাখে বার্ষিক পাঁচ দশ পাউন্ড বেতনের কর্মচারি হিসাবে। তাদের সামাজিক ও আর্থিক পটভূমি গৌরবময় ছিল না। নেহাত পোড়া মাছ আর পোড়া আলু ভোজী এই লোকগুলি শত শত বছরের মুসলিম বৈরি ক্রসেডার ও টেম্পলারের মনস্তত্ব নিয়ে সাগরের মাঝি-মাল্লারূপে ভাগ্যের অন্বেষণে এই সম্পদ ভান্ডারে প্রবেশ করে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট জোব চার্ণক কর ফাঁকি ও অন্যান্য অপকর্মের দায়ে ১৬৮৭ সাল থেকে বাঙলার সুবাহদার শায়েস্তা খানের তাড়া খেয়ে নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়ান। তিনি রাজধানী ঢাকার নাগাল থেকে দূরে ‘সংস্কৃত পান্ডিত্বের কেন্দ্রভূমি’ নবদ্বীপের জমিদার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের অধীনে গঙ্গাতীরের ধান ক্ষেত, কলাবাগান, জলাভূমি, দশ-পনেরো ঘর কৃষক ও জেলেদের কয়েকটি কুঁড়েঘর নিয়ে ক্ষুদ্র গ্রাম কলকাতা গ্রামের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্যাঁতস্যাঁতে জলাজঙ্গলময় কলকাতায় প্রথমে ১৬৮৭ সালে, এর পর তৃতীয়বার ১৬৯০ সালের ২৪শে আগস্ট নোঙর করেন। পাশ দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গানদী অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যের জন্য আর সাগরে পালিয়ে জান বাঁচানোর জন্য সুবিধাজনক ছিল।
নবদ্বীপের মুসলিম শাসন বিরোধিদের সাথে ক্রসেড চেতনার মিতালি
নবদ্বীপ বা নদীয়ার মুসলিম বিরোধী ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক পটভূমিটি ছিল গুরুত্বপূ্র্ণ। ষোল শতকে আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে সিলেটের ‘গৌরাঙ্গ’ এই নবদ্বীপকে কেন্দ্র করে ‘নবদ্বীপের চৈতন্য’রূপে ইসলামের ব্যাপক জনপ্রিয়তার হাত থেকে নিম্নবর্ণ বলে অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য ১৫০৬ সালে ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব মত’ নামে ‘হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলন’ শুরু করেন। হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের অত্যাচারের নানা কাহিনী প্রচার করে মুসলিম বৈরী মনোভাব সৃষ্টি করে, মুসলমানদেরকে প্রতিপক্ষ এবং শত্রু চিণ্হিত করে চৈতন্যের এই আন্দোলন হিন্দু মনে মুসলমান বিদ্বেষের তৈরি করে। নবদ্বীপের কাজীর ওপর হামলাকে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রথম ঘটনা বলা যায়। ডকটর রমেশচন্দ্র মজুমদার চৈতন্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপকেন্দ্রিক এই আন্দোলনকে তিনশ বছরের মধ্যে ‘ধর্ম রক্ষার্থে’ ‘মুসলমানের অত্যাচারের বিরুদ্ধে’ ‘অসম্ভব সম্ভব’ করার ঘটনা বলেছেন।
চৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলনের ভাবধারাকে অবলম্বন করে মুসলিম বৈরী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিক সাহিত্য আন্দোলন তখন থেকে নবদ্বীপ কেন্দ্রিক হিন্দু মানস ও চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে। চৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রায় সাত দশক পর সতেরো শতকের শেষ দিকে জোব চার্ণকের নোঙর করার সময়ও নবদ্বীপ বা নদীয়ার জাতীয়তাবাদী ও একজাতিত্ববাদী জমিদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের ও তার বংশধরদের এখতিয়ারাধীন এলাকায় তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় চৈতন্যের বাণী নিয়ে নবদ্বীপকেন্দ্রিক সাহিত্য আন্দোলন নতুন উদ্যমে সক্রিয় ছিল। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আশ্রয়রূপে এই এলাকাটি জোব চার্ণক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আশ্রয় ও বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে সবচে উপযুক্ত মনে করা হয়।
সেই থেকে সাড়ে ছয় দশকের মধ্যে নবদ্বীপের অতিশয় চতুর ও ষড়যন্ত্র পরায়ন কিছু লোকের সাথে তাদের মেলামেশা, চেনা-জানা ও বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে অভিন্ন স্বার্থের মিতালী তৈরি হয়। এই শ্রেণীটি ঐতিহাসিকভাব ছিল ষড়যন্ত্রপটু। কিন্তু সাহস ও ক্ষাত্রতেজে ছিল ভেজা বেড়াল। পনেরো শতকের শুরুতে ইলিয়াস শাহী সুলতানদের বিরুদ্ধে গণেশের রাজনৈতিক উত্থান চেষ্টা আর ষোল শতকে চৈতন্যের নেতৃত্বে আলাউদ্দীন হোসেন শাহর সময় সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও তারা প্রতিটি নতুন মওকা কাজে লাগাতে ততপর ছিল।
ইয়োরোপীয় বনিকদের সাগরজয়ী সাহস ও সমর কুশলতা আর তাদের মুসলিম বৈরী মনস্তত্ব তাদের পুরনো আক্রোশ বাস্তবায়নে নতুনভাবে অধিক ততপর করে। তারা বনিকদেরকে মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংশের নানা ঘুপচিগলি চিনিয়ে দেয়। শলা-পরামর্শ ও সহযোগিতা যোগায় ঘোর বিপদে সাহায্যের হাত বাড়ায়। এভাবে বনিকের তূলাদন্ডকে শাসকের মানদন্ডে পরিণত করতে সর্বোত সহযোগিতা করে তাদেরকে মসনদের সিঁড়িতে পৌছিয়ে দেয়।
বাঙলার গুদামখানায় ইংরেজদের প্রকাশ্য হানা
১৭৫৭ সালে পলাশীর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বার্ষিক পাঁচ দশ পাউন্ড বেতনের কর্মচারিরা নানা ছলে মুরশিদাবাদের নওয়াবের কাছ থেকে লাখ লাখ পাউন্ড ঘুষ আদায় করে রাতারাতি ইংল্যান্ডের সেরা ধনী হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। নবদ্বীপের সহযোগীরাও তাদেরকে ব্যবসায়ের নানা চোরাগলি দেখিয়ে দেয়। দুই দল মিলে সীমাহীন লোভ আর প্রচন্ড হিস্রতা নিয়ে মুসলিম আমলের শত শত বছরে কড়ি থেকে স্বর্ণমুদ্রার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত সমৃদ্ধ সুবাহ বাঙলার ‘বিশাল গুদামখানা’য় হামলে পড়ে।
রাতারাতি তারা ব্যবসা-বানিজ্যে একাধিপত্য কায়েম করে। দেশী উৎপাদকদেরকে কম দামে পন্য বেচতে আর চড়া দামে বিলাতি পণ্য কিনতে বাধ্য করে বাজারব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংশ করে ফেলে। অনেক পাশ্চাত্য পর্যবেক্ষক এই ধ্বংশতান্ডবকে বলেছেন ‘প্রকাশ্য দস্যুতা’।
মীর কাসিমের বালুর বাঁধ
মীর যাফর তাদের লোভের বল্গাহারা ঘোড়ার সাথে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হলে তারা তাকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাসিমকে মসনদে বসায়।
মীর কাসিম পরাধীনতার যাতনা আগে থেকেই টের পাচ্ছিলেন। মসনদে বসে তিনি শ্বশুরের মতো ‘ক্লাইভের গাধা’ না হয়ে স্বাধীন নওয়াবের মতো নড়াচড়ার চেষ্টা শুরু করেন। তিনি ষড়যন্ত্রের দায়ে রামনারায়ন, মুরলীধর, জগতশেঠ, রাজবল্লভ ও উমেদরায়কে শাস্তি দেন। ইংরেজরা একতরফা শুল্কমুক্ত বানিজ্য সুবিধা ভোগের ফলে দেশী ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতায় ধ্বংশ হচ্ছিলেন। তিনি সবার শুল্ক বাতিল করেন। তিনি মুরশিদাবাদ থেকে তার রাজধানীও ইংরেজদের দৈনন্দিন হস্তক্ষেপ থেকে দূরে মুঙ্গেরে সরিয়ে নেন।
মীর কাসিমের এসব পদক্ষেপের আগেই তখন গঙ্গা-ভাগিরথির পানি অনেক গড়িয়ে গেছে। ইংরেজরা মীর কাসিমের স্বাধীনতার স্বপ্ন ভন্ডুল করতে ক্ষীপ্র গতিতে পাটনায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট ও বহু নরনারীকে হত্যা করে। ১৭৬৩ সালের ৭ জুলাই তারা মীর যাফরকে কলকাতার নির্বাসন থেকে ফেরত এনে ফের মুরশিদাবাদের গদীতে বসায়।
ইংরেজ হলো বাদশাহর দীউয়ান
মীর কাসিম গিরিয়া ও উদয়নালায় ইংরেজদের মোকাবেলা করেন। আশ্রয় নেন অযোধ্যায়। দিল্লীর মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার বাহিনীর সাথে মিলে ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর বখশারে ইংরেজদের মোকাবেলা করেন। পলাশীর বেঈমানির পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে বখশার যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটি সনদের মাধ্যমে বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যায় তার ‘দীউয়ান’ বা রাজস্ব অফিসার হিসাবে নিযুক্ত দিতে বাধ্য হন। ফলে বিদেশী বনিক কোম্পানি নযীরবিহীনভাবে এখানকার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় বা আর্থিক প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পায়।
এর মধ্য দিয়ে সুবাহর শাসন ব্যবস্থায় অভাবিত মোড় বদল ঘটে। মুরশিদাবাদে পুতুল নওয়াব রেখে আর্থিক প্রশাসন বিদেশী বনিকদের হাতে দিয়ে দ্বৈত শাসনের নামে ক্ষমতার বিরাট পালাবদল ঘটে বখশার যুদ্ধের মাধ্যমে। তাই কিছু ঐতিহাসিক বখশারের তাতপর্য পলাশীর চেয়ে গভীরতা মনে করেছেন।
দুর্ভিক্ষে দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু
দিল্লীর বাদশাহর সনদবলে বাঙলার দীউয়ানের দায়িত্ব নেয়ার সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুসলিম শাসনব্যবস্থার সকল বিধি-বিধান ও রীতি-রেওয়াজ মানার ওয়াদা করে। কিন্তু অতীতের চেয়েও দ্রুত তারা এবারে ওয়াদা ও চুক্তি ভেঙে বাঙলার ভূমিব্যবস্থার দীর্ঘপ্রচলিত সকল পুরনো প্রজাসহায়ক নিয়মগুলি বদলে ফেলে।
মোগল আমলে কৃষকেরা ফসলের দ্বারা খাজনা আদায় করতেন। ইংরেজরা নগদ অর্থে রাজস্ব আদায় চালু করে। তাদের নয়া রাজস্বনীতি আর খাজনা আদায়ের নিষ্ঠুরতা কৃষকদের জন্য ভয় ও বিপদ সৃষ্টি করে। তারা খাজনার ধার্য এক ধাক্কায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। এর পর একে একে নানা অন্যায়, অনৈতিক ও নিষ্ঠুর কৌশল ব্যবহার করে রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে চলে।
কৃষকরা খাজনার নগদ টাকা যোগাড় করতে বছরের খাদ্য ফসল বেচে ফেলতে বাধ্য হন। ইংরেজরা তখন মুনাফা শিকারের নতুন ফন্দি হিসাবে নানা স্থানে অসংখ্য ব্যবসা-কেন্দ্র খুলে বসে। ১৭৬৮ সালে কলকাতায় দীউয়ানী দফতর স্থাপনের পর তাদের লোভী ততপরতা আরো তীব্র হয়।
১৭৬৯ সালে ফসল ওঠার সাথে সাথে ইংরেজদের দেশী বিদেশী কর্মচারী আর তাদের আমলা গোমস্তা, রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা যে যেখানে ছিল, ধান-চাল কিনে গোলা, মড়াই, আড়ত, কাচারী বোঝাই করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। মোগল সাম্রাজ্যের সবচে সমৃদ্ধ প্রদেশ বাংলা ও বিহারের পরিচয় ছিলো ‘ভারতের শস্য ভান্ডার’। মুসলিম শাসনের দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ শো’ বছর এ এলাকা একচেটিয়া ব্যবসায়ের এমন নিষ্ঠুর মৃত্যুফাঁদের সাথে পরিচিত ছিল না।
বনিক রাজত্বের নিষ্ঠুর উদ্ভাবনা কলে আটকা পড়ে কৃষক ও কারিগররা নিজেদের উতপাদিত খাদ্যশস্য কয়েকগুণ বেশি দামে কিনে সর্বস্বান্ত হলেন। গণমৃত্যু শিকার কৃষকরা গরু-বাছুর গবাদি পশু, কৃষির লাঙল-জোয়াল যন্ত্রপাতি বিক্রি করে বীজধান খেয়ে সাবাড় করেন। গাছের পাতা, ক্ষেতের ঘাস খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন। শেষে বহু লোক ছেলে-মেয়ে বিক্রি করেন। সেই ক্রেতা চাহিদাও কমে যায়। ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ মানুষের গোশত খায়।
এই ‘অচেনা দুর্যোগ’-এর এই নিষ্ঠুর আঘাত সম্পর্কে মলী লিখেছেন: ‘চাষীরা ক্ষুধার জ্বালায় সন্তান বেচতে বাধ্য হন। কিন্তু কেনার লোক নেই। কে তাদের কিনবে? কে তাদেরকে খাওয়াবে? বহু এলাকায় জীবিত লোকেরা মরা মানুষের গোশত খেয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন। লাশ আর মুমূর্ষু মানুষে নদীর তীর ছেয়ে যায়। মরার আগেই মুমূর্ষুদের দেহ শিয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেলে।’ (L.S.S.O. Molley : Bengal, Bihar and Orissa under British Rule, P-113)।
হান্টার লিখেছেন: পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির সাথে মরা মানুষের লাশের সাথে পথে পথে আধমরাদের বিশৃংখল স্তূপ তৈরি হয়। নির্বিচারে কবর দিয়েও লাশের সুরাহা সম্ভব হয় না। ‘প্রাচ্যের ঝাড়ুদার’ নামে পরিচিত শিয়াল-কুকুরেরাও লাশ সাফাইয়ে ব্যর্থ হয়। পচা-গলা লাশ নাগরিক জীবন বিপন্ন করে তোলে। সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ১৭৭০ সনের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মারা যান। জুন মাসের হিসাবে বলা হয় ‘সমগ্র জনসংখ্যার প্রতি ষোল জনে ছয় জন মারা গেছেন’।
তবু খাজনা বাড়ে
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (১১৭৬ সন; ১৭৬৯-৭০ খৃ) ফলে বাঙলা ও বিহারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসের হিসাবেই এক কোটি পঞ্চাশ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। মানুষের সংখ্যা কমে চাষাবাদ বন্ধ হয়। এক তৃতীয়াংশ জমি পতিত পড়ে। তবু ‘ক্রুসেডার’ উপনিবেশিকরা খাজনা আদায় বাড়িয়ে চলে। বকেয়া খাজনার দায়ে ‘ঋণগ্রস্তদের কারাগার’ বোঝাই হয়। কিন্তু উপনিবেশিকদের কাছে এ মানবিক বিপর্যয় নিছক ‘জমি চাষ করার লোকের অভাবজনিত সংকট’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। হেস্টিংস ১৭৭২ সালে ইংল্যান্ডে পাঠানো এক চিঠিতে বলেন: ‘প্রদেশের লোক সংখ্যা কমার ফলে চাষের অবনতির সত্বেও সকল শক্তি দিয়ে রাজস্ব আদায় করার ফলে ১৭৬৮ সালের তুলনায় ১৭৭১ সালের রাজস্ব আদায় বেশী হয়েছে। (ডবলিউ ডবলিউ হান্টার : গ্রাম বাংলার ইতিকথা (এ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল) অসীম চট্টোপাধ্যায়ের তরজমা, পৃ: ১০-১৭, ২৯-৩১)।
দুর্ভিক্ষের পর ঢাকা
কোম্পানী শাসনে মোগল সাম্রাজ্যের ‘শস্য ভান্ডার’ দুর্ভিক্ষের স্থায়ী কেন্দ্রে পরিণত হয়। মন্বন্তরের জের চলে অন্তত দুই পুরুষ ধরে। প্রথম পনেরো বছর জনসংখ্যার ঘাটতি বাড়তে থাকে। ঢাকায় ১৭৮৪ থেকে ১৭৮৮ সালের মধ্যে একের পর এক দুর্ভিক্ষে গণমৃত্যুর সবচে বড় শিকার হয় শিশুরা। ১৭৮৫ সন পর্যন্ত বৃদ্ধরা মারা যান। জেনারেল গ্যাপ পূরণে নতুন প্রজন্ম ছিল না। জমি পতিত পড়ে থাকে।
মোগল সুবাহদারী আমলের দুই রাজধানী ঢাকা ও মুরশিদাবাদে জনসংখ্যা দ্রুত কমে যায়। ঢাকা নিয়াবত এলাকার কয়েকটি ‘পরগণা’ সম্পূর্ণ জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ। কোম্পানি আমলে ঢাকার লোকসংখ্যা এক লাখের নীচে নেমে যায়। ১৭৮৭-৮৮ সালের দুর্ভিক্ষের সময় পূর্ব বাংলায় মাত্র ত্রিশ টাকায় একটি ছেলে এবং কুড়ি টাকায় একটি মেয়ে কিনে ফিজি, মরিশাস, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আমেরিকার বাজারে বিক্রি করে দাশ-ব্যবসায়ীরা প্রচুর কামাই করে নেয়।
তিন বছর জরিপের পর ১৭৮৯ সনে লর্ড কর্ণওয়ালিস বাঙলায় কোম্পানীর এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে ‘বন্যজন্তু আকীর্ণ জঙ্গল’ ঘোষণা করেন।
‘ওরাঙ ওটাঙ ও নেকড়ের শাসন’
মানবেতিহাসের নযীরবিহীন অসৌজন্যের ফলে ক’বছরের মধ্যে বাঙলার স্বনির্ভর গ্রাম-সমাজের ভিত্তি ও কাঠামো ধ্বংশ হয়। দুর্ভিক্ষের বছরগুলিতেও খাজনার দাবি বাড়তে থাকে। ১৭৭২ সালে তা দশ লাখ পাউন্ড আর ১৭৭৬ সালে আরো বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড। অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতার এই বীভতসতা দেখে মনুষ্যবোধসম্পন্ন প্রতিটি অন্তর কেঁপে উঠেছে। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই নব্য টেম্পলাররা তাদের আঠারো শতকের এই দুষ্কর্মের জন্য মেটেই অনুতাপ বা শরম না পেয়ে খাজনা আদায়ে তাদে হিংস্র কৌশলের জন্য গর্ব করে।
শাসনের নামে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির এই কদর্যতা দেখেই এ্যাডাম স্মিথ বনিক শাসনকে ‘সকল প্রকার শাসন-ব্যবস্থার মধ্যে নিকৃষ্টতম’ বলে রায় দিয়েছেন। আর এডমন্ড বার্ক ‘মৃত্যুব্যবসায়ী’ এই বনিকদের আচরণকে বলেছেন মানবেতিহাসে নযীরবিহীন ‘ওরাঙ ওটাঙ ও নেকড়ের শাসন’ এবং ‘মৃত্যুর শাসন’।
দুর্ভিক্ষে জন্ম নেয়া কলকাতার ‘নব্য রঈস’
দুর্ভিক্ষ বাঙলার প্রাচীন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজের চিত্রটি পুরা বদলে দেয়। ব্যবসার নামে লুটপাট করে কোম্পানির কর্মচারীরা আরো ফেঁপে ওঠে। মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারের কপর্দকহীন ইংরেজও দুর্ভিক্ষের পর ষাট হাজার পাউণ্ড বিলাতে পাঠায়।
কোম্পানীর প্রত্যক্ষ মজুতকারবারীদের সাথে সাথে কোটিপতি লগ্নি-পুজির মালিক জগত শেঠ, আলম চাঁদদের তো কথাই নেই, কোম্পানীর কর্মচারীদের অতি উতসাহী সহযোগি দালাল, দেওয়ান, বেনিয়ান বা মুৎসুদ্দী, নিলামে জমিদারী খরিদকারী নতুন শহুরে জমিদার, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তাদের দালাল, নায়েব, গোমস্তারা ইংরেজদেরকে দ্রুত লুটের গোপন পথের সন্ধান দিয়ে, লুটের উপযুক্ত মৌসুমের হদিস দিয়ে এবং আরো নানা কৌশল শিখিয়ে দুর্ভিক্ষের অনুঘটকরূপে ম্যালা বখরা হাসিল করে রাতারাতি কাড়িকাড়ি কাঁচা টাকার মালিক হয়ে গেলো।
দেশীয়দের এই শ্রেণীটীর মধ্যে অপকর্মে সবচে কুখ্যাতি পেয়েছিল দয়ারাম দত্ত, কেবলরাম ঘোষ, রামপ্রসাদ মিত্র, বারানসী ঘোষ, হৃদয়রাম বা হেদারাম ব্যানার্জী, অক্রুর দত্ত, মনোহর মুখার্জী, মদন দত্ত, দর্প নারায়ণ ঠাকুর, নবকৃষ্ণ, গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, কৃষ্ণকান্ত নন্দী, লক্ষীকান্ত ধর, রাজনারায়ণ রায়, শান্তিরাম সিংহ, রামলোচন ঘোষ, গোকুল মিত্র, রামচরণ রায়। এই শ্রেণীটিও ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের নগদ কামাই ঘরে তুলে কেউ কলকাতার ‘নব্য রঈস’, কেউ ‘ব্ল্যাক জেমিন্দার’ কেউ রাজা-মহারাজা বনে যায়। এ দেশীয় এই নীতিহীন, লোভী, চতুর ও নিষ্ঠুর মানুষদের সামনে রেখে ইয়ং হাসবেন্ড লিখেছেন, ‘দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতা’র কারণেই ‘একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতি’র সেই ‘পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার কাহিনী’ অনাগত কালের মানুষের কাছে ক্রুঢ়তার অভুলনীয় উপমা হয়ে থাকবে। [Young Husband : Transactions in India (1786), P-123]) ।
(চলবে)
ঊনিশ শতকের বাঙালি মুসলিম সমাজ ও মুনশী মেহের উল্লাহ_মোহাম্মদ আবদুল মান্নান : পর্ব-২

Recent Comments