আর মাত্র কয়েক দিন। এখনো টাকা যোগাড় হয়নি বজলু সাহেবের। টাকা যোগাড় হবে কিনা তিনি জানেন না। অথচ সকালে যখন রফিক ভাই জানতে এসেছিল কোরবানির কী করেছি? তিনি তখন অনেক কষ্টে রাগ দমন করে বলেছিলেন, ‘ভাইজান, এখনো চিন্তা করিনি কী করবো? সম্ভবত এবার আর আপনাদের সাথে দেয়া হবে না।’
‘একা দিবা?’
‘পারলে একাই দিব।’
‘জান- এবার গরুর বাজার কেমন?’
‘তা জানি না। তবে একাই দিব।’
একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনে চাকরি করেন বজলু সাহেব । মাস শেষে যে বেতন পান তা দিয়ে কোন রকম সংসার চলে, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চলে। এ বেতনে কোরবানি দেয়া একধরণের বিলাসিতা। তবুও তিনি প্রতি বছর ধার দেনা করে চাচাতো ভাইদের সাথে শরীকে কোরবানি দেন।
এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর শরীকে দিবেন না।
তিনি মনে করেন, শরীকে কোরবানি দিলে- কোরবানি কবুল হবে না। যত জন শরীকে কোরবানি দিয়, তত জন গোস্তই পায়।
এ গোঁড়ামি মার্কা ফতুয়া তিনি নিজে নিজেই গত বছর দাঁড় করিয়েছেন।
গত বছর ঈদের তিন দিন আগে কথা। তিনি অফিস থেকে বাড়ি ফিরছেন। পথেই এক পরিচিত গরু ব্যাপারীর সাথে দেখা। লোকটি বজলু সাহেব কে বলল, ভাইজান, গরু কিনবেন না? ভালো কিছু গরু আইছে । দেখেন। আরে দামের লাই চিন্তা কইরেন না। আপনা গো লগে কি আর দামাদামি করতে পারুম।’
‘গরুর ভালমন্দ আমি বুঝি না। আমি এসবে নাই। আমার শরীকেরাই কিনবে।’
‘আরে ভাইজান দেখেন না একবার। গরু গুলা কেমন আইছে। কিনবেন নাকি কিনবেন — সেটা পরে ভাইবেন। চলেন। আপনারে একবার দেহাই।’
গরু ব্যাপারীর পিড়াপিড়িতে বজলু সাহেব গোবর টোবর ডিঙ্গিয়ে সব গুলা গরু দেখল। এবং একটা গরু পছন্দও করে ফেলেছে। গরুটা এমন লালচে রঙ, গোলগাল গঠন পছন্দ করারই মতো। কথা কথায় গরুটা কিনেই নিলেন তিনি।
এরপরই হলো বজলু সাহেবের গরু কিনার উচিৎ শিক্ষা ।
গরু দেখে শরীকদারদের একজন বলল, ‘কি গরু কিনল এটা! এ ছাতার গরু এক লাখ বিশ হাজার টাকা? কখনই হতে পারে না।’
অন্যজন বলল, ‘ঐ ফজলরা নব্বুই হাজার টাকা দিয়ে যে গরু কিনছে এটাতো হেটার চেয়েও ছোটো। হেটার কমপক্ষে এটার থেকে আধমণ গোস্ত বেশি হবে।’
রফিক ভাই বলল, ‘হেতার গরু। হেতে কোরবানি দেক। আমি এর মধ্যে নাই বাপু। আমি দেখি অন্য কারও সাথে কোরবানি দিতে পারি কিনা।’
গরুর একক মালিক হয়ে বজলু সাহেব আনন্দে আটখানা হতে পারেনি। তিনি পড়লেন ভীষণ বিপদে। গরুর ব্যাপারী বলেছিল যে সে গরু ফিরত নিবে না। কী করবেন তিনি ভেবে না পেয়ে স্ত্রী সন্তানের সামনে কেঁদে দিলেন। এ সহজসরল মানুষটার কান্না দেখে সেদিন স্ত্রী সন্তান সবাই অঝোরে কেঁদেছে।
যারা এখনো গরু কিনে নাই তাদের কয়েক জনকে তিনি গরুটা দেখিয়েছেন। কিন্তু কেউ গরু কিনতে রাজি হয়নি।
শেষে তিনি গরু ব্যাপারীর হাত পা ধরে কান্নাকাটি করে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গরুটা ফিরত দেন।
তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জীবনে কখনো শরীকে কোরবানি দিবেন না।’
এ ছাড়াও তিনি যুক্তি দাঁড় করেছেন যে সকল শরীকদার হালাল টাকা দিয়ে কোরবানি দেয় না। কেউ কেউ নামাজ কালাম কিছুই পড়ে না। তাদের সাথে কোরবানি দিলে নিজের কষ্টে উপার্জিত হালাল টাকা দিয়ে গোস্ত কিনা হবে। কোরবানি হবে না।
সারাদিন কোনক্রমেই তিনি কোরবানির টাকা যোগাড় করতে পারেননি। দুশ্চিন্তায় চেহারা খারাপ করে যযখন ঘরে প্রবেশ করল, তখন স্ত্রী চিৎকার দিয়ে বলল, ‘কি গো, কী হয়েছে আপনার? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
‘না, কিচ্ছু হয়নি তো।’
‘বললেই হল কিচ্ছু হয়নি। কোন কিছু নিয়ে কি চিন্তা করছেন?’
‘হুম, কোরবানির টাকা এখনও যোগাড় হয়নি।’
‘চিন্তা কইরেন না। প্রয়োজনে এবার ছোটমোটো ছাগল দিয়ে কোরবানি দিব।’
‘ছাগল দিয়ে দিবো? ‘
‘ছাগল দিয়ে দিলেও কোরবানি হবে।’
‘ তাও হবে। তবুও কেমন যেন….’
হ্যাঁ, পাঠক। গল্পের বজলু সাহেব শুধু একাই কোরবানির সময় দুশ্চিন্তায় পড়ে না। হাজার হাজার বজলু সাহেব দুশ্চিন্তায় পড়ে। সে সব বজলু সাহেবদের বলছি, সহীহ নিয়তওলা, হালাল রুজিরোজগার ওলা, নামাজি শরীকদার না পেলে প্রয়োজনে ছোটো ছাগল দিয়ে কোরবানি দেন। একা দেন। কারণ আল্লাহ কোরবানির মাংস চায় না। আল্লাহ্ বন্দার তাকওয়া চায়।
কোরবানি_আল আমিন

Recent Comments