২২ বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি বক্তৃতাবিলাসী আবেদন-নিবেদন-নির্ভর বাকসর্বস্ব রাজনীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ‘ভারতী’ পত্রিকায় পরপর কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন ১২৮৯ সালের চৈত্র থেকে ১২৯০ সালের চৈত্র পর্যন্ত- ‘চেঁচিয়ে বলা’, ‘জিহ্বা-আস্ফালন’, ‘টৌনহল তামাসা’, ‘ন্যাশনাল ফন্ড’ ইত্যাদি৷
‘ন্যাশনাল ফন্ড’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ রচনাটিতে যুবককবি বলেছিলেন- ‘ইংরাজীতে শিক্ষা কখনই দেশের সর্বত্র ছড়াইতে পারিবে না’৷ অতএব দেশময় ছড়িয়ে দিতে হবে মাতৃভাষার ‘বঙ্গবিদ্যালয়’৷ শিক্ষা বলতে কবি প্রধানত জনশিক্ষাই বুঝতেন- মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থভোগী শ্রেণির ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নয়, যাদের বাংলা মিডিয়ামের বদলে ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে পড়াবার জন্য অভিভাবকদের মধ্যে একটা ন্যক্কারজনক উন্মত্ততা দেখা দিয়েছিল তাঁর কালে, যা আমাদের কালে তারও বহুগুণ বেশি হারে ফিরে এসেছে৷
বাংলা বাদ দিয়ে সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বহুগুণ উচ্চ মূল্যের শিক্ষা-খরচ কবুল করে দূর দূরান্তের নারিন্দা-গেন্ডারিয়া-মুগদা-জিঞ্জিরা থেকে মাতা বা পিতাদের রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোর ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলগুলোতে সময়মত ছেলেমেয়েদের ঢুকিয়ে দিয়ে (অনেকসময় অসমবয়সী দুজনকে দুই শিফটে) ছুটির পরে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিনমান কাটাতে হয় আশেপাশের চাহিদা সীমা ছাড়িয়ে বেড়ে যাওয়ার কারণে দিনে দিনে এসব স্কুলের সংখ্যা এতই বেড়েছে যে স্কুল চলাকালীন যানজটে ধানমন্ডিবাসী আমি না পারি ঘর থেকে বাইরে যেতে, না পারি বাইরে থেকে ঘরে ফিরতে।
এই অশুভ তৎপরতার ফলাফলস্বরূপ আমাদের শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীগণ এখন আর চিঠি পাঠায় না, সেন্ড করে; চাকরি করে না জব করে; কথা বলে না, চ্যাট করে; সৃজন করে না, ফিউশন করে, উৎসবে যায় না, ফেস্টে যায় (ফেস্টিভ্যালে), কৃতী হতে চায় না, সেলেব হতে চায় (সেলেব্রিটি), নিমন্ত্রণ করে না, ইনভাইট করে; অনুষ্ঠানে গিয়ে নবদম্পতির জন্য প্রার্থনা কামনা করে না ইংরেজি নিমন্ত্রণপত্র, সেরিমনিটির গ্রেস বর্ধন আশা করে; ১৪ ফেব্রুয়ারি বলে না, ভ্যালেন্টাইন-ডে বলে; ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ ফলে এদিনে বাঙালিও উপহার দেয় না, ভ্যালেন্টাইন দেয়।
এদিনটিতেই আমাকে একুশে বইমেলায় যেতে হয়েছিল মেলা-মঞ্চের সেমিনারে সভাপতিত্ব করতে। আলোচ্য বিষয় ছিল একুশের গান, শহীদমিনারের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। বাৎসরিক প্রবন্ধপাঠ ও আলোচনা চলল দীর্ঘ সময় ধরে। বস্তুত চলল ঘুরেফিরে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক আনুষ্ঠানিক শোচনা। সভাশেষে আমিও ঘুরেফিরে একুশের বাৎসরিক বইমেলা দেখলাম। সহযাত্রী হিসেবে সঙ্গে নিলাম কিছু নবীন কবি-সাহিত্যিক, বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ স্টলগুলো দেখিয়ে দেওয়ার জন্য।
কিছুক্ষণ দেখলাম ছেঁদো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আর খেলো বইয়ের উন্মোচিত বক্ষে অটোগ্রাফ দানের বেশরম ব্যবসা। অকস্মাৎ আমাদের উচ্ছল যাত্রীদলটি যেন হিমশীতল হয়ে গেল – চুপচাপ ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশ থেকে শব্দবোমার মতো উড়ে-আসা ‘ড্যাডি-মামি-ড্যাড-মম-আংকেল-আন্টি’ শুনতে শুনতে। এক সময় আমরা পৌঁছে গেলাম ‘আত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’টির ধূলিধূসর মেলার মূল প্রাঙ্গণে।
অতঃপর দুটি বনেদী প্রকাশনার স্টল থেকে কিছু ভালো বই সংগ্রহ করলাম এবং অল্প সময়েই নিভে গিয়ে ঘরের দিকে ফিরে চললাম নিঃশব্দে, নতমুখে। দোয়েল-চত্বর দিয়ে বেরুবার মুখে সারিবাঁধা ফাস্টফুডের কেবিন থেকে ‘ফিশফ্রাই-চিকেনফ্রাই-হটডগ-চিলিবিফ’ ইত্যাদির অর্ডার এবং সাপ্লাইয়ের ইংরেজি শব্দাশব্দির দূষিত বাতাস গিলতে গিলতে একসময় ভাষার মাসের একুশে বইমেলাটি থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম এবং নিজেকেই প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম – বাংলার মাটিতে বাংলাভাষার প্রতি অবজ্ঞা কি এভাবেই চলতে থাকবে?
চলতে না দেবার আশায় আরম্ভের মতো অন্তেও রবীন্দ্রনাথের কথাই স্মরণ করাতে চাই৷ মৃত্যুর মাত্র দুমাস আগে কবিগুরু রোগশয্যা থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাফাইগায়িকা মিস র্যাথবোনের উদ্দেশ্যে ভৎর্সনা-বক্তব্যে চাঞ্চল্যকর তথ্যের উল্লেখ করেছিলেন:
‘যদি ধরিয়া লওয়া হয় যে, ইংরাজী ভাষা ছাড়া আমাদের জ্ঞানালোক পাইবার অন্য পথ নাই, তবে কেন ‘সেই ইংলন্ডীয় চিন্তাধারার উৎস হইতে আকণ্ঠ বারি পান করিবার ফলে’ দুই শতাব্দীব্যাপী ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৩১ সালে আমরা দেখিতে পাই, ভারতের সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র একজন ইংরাজী ভাষায় লিখন পঠনক্ষম (literate) হইয়াছে৷ অন্যদিকে, রাশিয়ায় মাত্র ১৫ বৎসরের সোভিয়েট শাসনের ফলে ১৯৩২ সালে সোভিয়েট ইউনিয়নের শতকরা ৯৮টি বালকবালিকা শিক্ষালাভ করিয়াছে (এই সংখ্যাগুলি ইংরেজ প্রকাশিত ‘স্টেটসম্যান ইয়ার বুক’ হইতে উদ্ধৃত)৷ এই বহির রাশিয়ার অনুকূলে পক্ষপাতভ্রান্ত হইবার সম্ভাবনা নাই।’
শেষ করি আমার একটি বাক্য দিয়ে- বাঙালি যেন মনে রাখে যে, শত্রু হিসেবে ‘শাদী মোবারকে’ দাওয়াত করার উর্দুর চেয়ে ‘ম্যারেজ সেরিমনি’তে ইনভাইট করার ইংরেজি বহুগুণ বেশি শক্তিশালী।
Recent Comments