মা কইছিল এক বছর বন্যার পর ডাইরিয়া হইয়া বাপ মাইরা গেছে। বেধবা মা কোন মতে মানুষের বাড়ি কাম কইরা আমগো দুই বোনরে বাঁচায় রাখছে। জন্মের পর থেক্কাই দেখছি অভাব, দারিদ্র, বাইচ্চা থাকনের লড়াই।
বাপ ছাড়া মাইয়াগো বড় করতে মায়ে আমার বহুত পরিশ্রম করতো। পদ্মার ভাঙ্গনে ফি বছরাই ঘর-দোর ভাঙ্গে। হাজার হাজার মানুষ হয় সর্বশান্ত। পেত্তেক বছরই বন্যায় ডুইয়া যায় আমাগো গেরাম।
সে বছর বন্যার সময় কি এক সাপের কামড়ে মইরা গেল আমার বুজান। মায়ে খুব কাঁন্দিছিল সেদিন।
বেধমা মা আমারে ঠিকমত খাওন দিবার পারতো না। বাধ্য হয়েই বারো বছর পার হতি না হতিই আমারে বে দেদিল করিম মাঝির লাগে।
করিম মাঝি গতর খাটতে জানে, মাছ ধরে, জাল বুনে। খাওনের কষ্ট থেকে রেহাই পাই আমি। সোয়ামীর আমার ঘরও আছে। তয় সে ঘর সরকারী জায়গার উপর ছেঁচার বেড়া দিয়ে বানাইছে।
নেকাপড়া জানি না বইলাই বিয়ার প্রথম বছরই শরীরের মধ্যি বাসা বান্ধে আরেক শরীর। পোয়াতী হইছি দেইখা সোয়ামীর আমার কও আহ্লাদ! কাম শেষে বাড়িত ফেরনের সময় পাঁকা কলা, পেঁপে নিয়া আহে। আমার হাতের কম নিজে কইরা দেয়।আফসোস কইরা কয় ট্যাকা নাই দেইখা ইচ্ছা থাকন সত্ত্বেও দুধ- মাখন খাওয়াইতে পারি না তরে বউ।
সাবুর জন্মের সময় বেজায় কষ্ট হইছে। তয় সাবুর কঁচি মুখখান দেহনের লগে লগে ব্যাবাক কষ্ট চইলা যায়।
দাই মা সাবুরে কোলে দেওনের সময় কইছিল “ধ্যাংগা বয়সে মা হইছো, বাচ্চাডারে সামলাইয়া রাইখো।”
হ সাবুরে আমি বুকে আগলাইয়া রাখছি। সারাদিন সংসারের কাম কইরা, জাল বুইনা সাবুরে সামলাইতে বড় কষ্ট হইতো।
সাবু যহন আছাড় খাইয়া খাইয়া হাঁটতে পারে তহন আবার আমি পোয়াতি হই কিন্তু বাঁচাইতে পারি নাই মাইয়াডারে। দুই বছর বয়সে বাড়ির সামনের ডুবায় পইরা মইরা গেছে মা আমার।
হেরপর একে একে আরও দুইডা পোলার জন্ম দিছি। পোলাগো নিয়া ভালাই যাইতেছিলো আমাগো দিন।
সংসারে দু-বেলা দুমুঠো খাওন আছে। মাথা গুজবার ঠাঁই আছে, ভালোবাসনের মানুষ আছে আর কি চাই! গরীবের আছে এইডাই স্বর্গ।
আচমকা আমার স্বর্গে ঝড়ের ঝাপটা আইলো। দুমড়ায় মুচড়ায় গেল আমার স্বর্গ। গরীবরে আল্লাহ চোখ দিছে ঠিকই কিন্তু স্বপ্ন দেখার অধিকার দেয় নাই।
প্যাটে বিদ্যে না থাকলে সুস্থ মানুষটারেও জমে টাইনা নেয়। সুস্থ সোয়ামী আমার কামে গেছিলো। পায়ে তলায় পুরানো জং ধরা এক জিনেরি ফুটে গেছিলো। সমর্থ মানুষটা গায়ে লাগায় নাই ব্যাপারটা।
পাঁচ-ছয় দিনের মদ্ধি গায়ে জ্বর আসলো, পা ফুইলা গেল। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলি ডাক্তার কইলো আর কিছু করনের নাই। মইরা গেল আমার সোহাগ করনের মানুষটা।
ঘরের চাল ফুরানোর লগে লগেই মাথায় বাজ পরলো। চারডা জুয়ান মুখের খায়ন জোগাইতে হইবো। পোলাগুলো নিয়া পদ্মার টলমল জলে হাবুডুবু খাইতেছিলাম, চোখখি আন্ধার দেখতাছিলাম। তারপর পুরুষমানুষ গুলানের নেকড়ের লোভী চোখ ২৭ বছরের আমার উপর। নিজের দেবরের অসভ্য ইঙ্গিতের জবাবে বটি নিয়ে কুরাতে গেছিলাম। চাপা গলায় কইলো “দেহি মুরুক্ষ মাইয়া মাইনসের ত্যাজ কতদিন থাহে।” মনের মধ্যে জেদ চাপলো পোলাপাইন মানুষ করমু, মাইয়া মানুষ বইলা সমাজে পঁচা প্যাকে ভাইসা যামু না।
শহরে এক বান্ধবী থাহে তার লগে যুক্তি কইরা পোলাগো লইয়া পাড়ি দিলাম শহরে। বান্ধবী দুই বাড়ি কামের জোগার কইরা দিল। আস্তে আস্তে আরও কয়বাড়ি কাম লইলাম। এপর বড় পোলাডারেও কামে দিলাম। দুই মায়ে বেটায় পরিশ্রম কইরা গেরামে একটুকরা জমি কিনলাম। এক বৌদিমনির দয়ায় ব্যাংক থেইকা লোন পাইলাম। জমিতে ঘর বান্দিলাম, পাকা ঘর। ছোড দুই পোলা গেরামে থাহে, নেকাপড়া করে। আমি আর বড় বেটা শহরে কাম করি। বড়লোকগো বাড়ি কামে যাইয়া অনেক রান্না শিখেছি কাবাব, চিলি চিকেন, রোস্ট, আরো কত কি! আমার রান্দা খাইয়া ধন্যি ধন্যি করে সক্কলে। তয় আমাগো গেরামের পদ গুলান খাইয়া আরও বেশি খুশি হয় তেনারা।
সেদিন ঘরের কাম করতেছিলাম তহন সাহেবের এক বন্ধু আইলো, সাথে সাথে রান্দার হুকুম পরলো। চট কইরা রান্দে দিলাম আমাগো গেরামের কয়ডা পদ। সাহেবের বন্ধু খাইতে বইসা তো হাত চাটতে লাগলো। খাওন খাইয়া বেজায় খুশি সে। আমারে কইলো “আমার একটা রেস্টুরেন্ট আছে। তুমি রান্না করবা সেখানে? মোটা টাকা বেতন দেব।”
আমার কপাল খুইলা গেল রেস্টুরেন্টে আইসা। মায়ে বেটায় কাম করি এহানে মনদিল দিয়া। মাস গেলে মেলা টাকা বেতন পাই। টাকা জমাইতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে দু’চোখে স্বপ্ন জমতে শুরু করলো নিজে রেস্টুরেন্ট দিমু।
যে মন থেইকা চায় আল্লাহ তার উপর দয়া করেন। আমার সাহেব বড্ড ভালো মানুষ, সেই আমারে ব্যাংক থেইকা লোন নিয়া দিল। নিজেই একখান রেস্টুরেন্ট খুললাম।
শুরু হইলো আমার দিন বদলের পালা। খাওনরে মান ভালো আর রান্দুন ভালো বইলা খুব তারাতাড়ি আমার রেস্টুরেন্টের নাম ছড়ায় পরলো। দূর দূরান্ত থেইকা মানুষ আইতে শুরু করলো। আল্লাহ ইচ্ছায় আমি আরেকটা রেস্টুরেন্ট দিলাম। একে একে চারড়া রেস্টুরেন্টের মালিক হয়ে গেল এই মুরুক্ষ মেয়ে মানুষ “আমেনা”।
কয়েক হাজার মানুষ কাম করে এখন আমেনার রেস্টুরেন্টগুলানে। সরকার কেমনে যেন আমার খোঁজ পাইলো। আমাকে উড়োপেলেনে কইরা নিয়া গেল। দিল বছরের সেরা উদ্যোগতার পুরুষ্কার। আমি টিপ সই দিয়া লেনদেন করি অথচ আইজ ব্যাংকে আমার অনেক ট্যাকা। তবুও মনের মদ্ধি মুরুক্ষ হবার দুঃখ থাইকাই গেল। সেই দুঃখ ঘুচাতে বড় পোলারে বিয়া দিলাম, বড় পাশ দেওয়া মাইয়ার লগে। আমার ছোট দুই পোলা এহন গাড়ি নিয়া ভারসিটি যায়। এহন আমাগো আর কোন দুঃখ নাই। মুরুক্ষ মাইয়া মানুষ বইলা সমাজের প্যারা কাদায় ডুইবা যাই নাই। অসহায় মাইয়া মানুষ বইরা যারা নোংরা ইঙ্গিত করছিলো আমি তাগো উচিত জবাব দিছি।
আজ আমার নাতনী হইছে। ফুটফুটে চান্দের নাহাল। মাইয়া হইলো ঘরের লক্ষী। আইজ আমার সংসার পূর্ন হইলো। মন কয় আমেনা তুই জিইতা গেছোস, তুই পারছোস।
জেদ_মনিরা মিতা

Recent Comments