ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যে এক প্রতিভাবান ও মৌলিক কবি হিশেবে বেশ সমাদৃত। তিনি কাব্যে প্রাক-ইসলামি যুগের বিষয়বস্তু ও চরিত্রকে আধুনিকায়নের মধ্য দিয়ে ইসলামের ধারাহিকতার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবার বাংলার লোক ঐতিহ্য ও পুঁথি সাহিত্যকে সময়ের প্রেক্ষাপটে পরিশালিত করে আধুনিক পরিভাষার মাধ্যমে মৃত প্রায় এবং উপেক্ষিত ঐতিহাসিক অনুসঙ্গকে বাঁচিয়ে রাখেন, যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে অনেকেই পুঁথি সাহিত্য চর্চার সাহস দেখায়।
তিনি কবি হিসাবে সমাদৃত হলেও কথা সাহিত্যিক হিসাবে ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটিকাসহ সাহিত্যের নানা শাখায় সফলতার সাথে বিচরণ করেন। অনুবাদ সাহিত্যেও ছিলেন দক্ষ। কিন্তু কবিতার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীত রচনায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। দেশ, জাতি ও সময়ের প্রয়োজনে তিনি সঙ্গীত রচনা করেছেন। সঙ্গীত রচনায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম এবং জসীম উদ্দীনের সমকক্ষ ছিলেন এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকেও ছিলেন তুঙ্গে।
কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক হিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর এ সকল কর্মকে নষ্ট করে ফেলা হয়। দীর্ঘদিন তাঁর দু’তিনটি গান ছাড়া বাকীগুলো লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। স্বাধীনতার পঁয়ত্রিশ বছর পর অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন মাত্র সাতটি গান সুর ও স্বরলিপিসহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এমন অনিশ্চিত যাত্রায় নৌকা ভাসিয়ে তাওহীদুল ইসলাম দীর্ঘ ছয় বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে নানা উৎসকে কাজে লাগিয়ে ১৮০টি গান সংগ্রহ করে ‘ফররুখ গীতি সংগ্রহ প্রথম খণ্ড’ প্রকাশ করেন। যা ইঙ্গিত বহন করে তিনি আরো বেশ কিছু গান সংগ্রহ করেছেন বা করার পথে আছেন, যা দ্বিতীয় খ-ে প্রকাশিত হবে বলেই আশা করা যায়।
তাওহীদুল ইসলাম ফররুখের গানগুলোকে ভাষা, স্বরলিপি ও সুর অনুসারে ‘স্বরলিপি’, ‘কাব্যগীতি’, ‘গীতিবিচিত্রা’, ‘সাকীনামা’, ‘সিন্ধু তরঙ্গ’, ‘দেশ ও ভাষার’ গান শীর্ষক অনুচ্ছেদে ভাগ করেছেন। তবে গানগুলো সংগ্রহের ক্ষেত্রে কি পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তা তাওহীদুল ইসলামের কথাতে স্পষ্ট: ‘ঢাকা বেতারে রেকর্ডকৃত অসংখ্য গান সংরক্ষণ নেই। আবার সংরক্ষণে থাকা কিছু গান নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর গান যারা সুর করেছে, স্বররিপি করেছেন কিংবা গেয়েছেন-দু’তিনজন ছাড়া সবাই ইন্তেকাল করেছেন। তাঁদের অনেকের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু সংরক্ষিত তেমন কিছু পাইনি। প্রতিকূলতা জেনেও দায়বদ্ধতা থেকে কাজে হাত দিযেছি।’
সংগ্রাহক চেষ্টা করেছেন গান ও স্বরলিপির উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করতে। যেমন স্বরলিপি সংগ্রহ করেছেন আসকর ইবনে শাইখ সম্পাদিত ‘নব জীবনের গান’, গীতিবিচিত্র ‘সাকীনামা’ সংগ্রহ করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা ‘অগ্রপথিক’ এবং ‘সিন্ধু তরঙ্গ’ সংগ্রহ করেছেন মোহাম্মদ শাকের উল্লাহ সম্পাদিত ‘ঊষালোকে’ সাহিত্য সংস্কৃতি পত্রিকা থেকে।
ফররুখ আহমদ কোন গানটি কোন প্রেক্ষাপটে রচনা করেছেন এবং কখন কোন মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়েছিল তাও এ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে কাজটি তিনি করেছেন তাহলো, গানগুলো কোন গুনী শিল্পীরা সুর করেছেন, গেয়েছেন এবং স্বরলিপি তৈরি করেছেন কার বিস্তারিত নাম উল্লেখ ও ছবি যুক্ত করেছেন। ফলে, গানগুলো সময়ের প্রেক্ষাপটে কতটা জনপ্রিয় ছিল এবং তার আবেদন আজও আছে কিনা তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য ‘ফররুখের গানে যাঁরা সুর দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন আবদুল হালিম চৌধুরী, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ, সমর দাস, মোশারফ হোসেন ফরিদ, উস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, শেখ লুৎফুর রহমান, বেদারউদ্দীন আহমদ, কাদের জামেরী প্রমুখ; তাঁর গানের স্বরলিপি করেছেন আবদুল লতিফ, মোশারফ হোসেন ফরিদ, ধীর আলী মিঞা, আবেদ হোসেন খান, মুনশী রইসউদ্দিন, বেদারউদ্দিন আহমদ, প্রমুখ; তাঁর গান গেয়েছেন শামসুন্নাহার করীম, মাহবুবা রহমান, আবদুল লতিফ, নীরু শামসুন্নাহার, আফসারী খানম, লায়লা আরজুমান বানু, বেদারউদ্দিন আহমদ, আলিমুজ্জামান (সাচ্চা), ফৌজিয়া খান প্রমুখ।’
ফররুখ আহমদ বাংলা ১৩৫২ সনে ‘আহমদ আবদুল্রাহ’ ছদ্মনামে মাসিক মোহাম্মদীতে ‘মোর গোপন কাহিনী জানো/ যে কথা জানে না/ নিশুত রাতের তারা/ যে কথা জানে না/ সাগরের বারিধারা॥’-গানটি প্রথম রচনা করেন। এর মধ্য দিয়েই তিনি গানের জগতে এক শক্তিমান মৌলিক রচয়িতা হয়ে উঠেন এবং রচনা করতে থাকেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। উল্লেখ্য, ‘দূর দিগন্তের ডাক এলো/ স্বর্ণ ঈগল পাখা মেলো/ পাখা মেলো॥’, ‘তুমি চেয়েছিলে মুক্ত স্বদেশ ভূমি/ তুমি চেযেছিলে এ বিরান মাঠে/ ফসলের মৌসুমী॥’, ‘হে নিশান ! ফের ঈঙ্গিত দাও মানবতার;/ হে নিশান ! ফের ইঙ্গিত দাও / মৃত যাত্রীকে পথ চলার/ ইঙ্গিত দাও মানবতা॥’, ‘এই আজাদী নিয়ে এল চাঁদ সিতারা;/ এল শিকল ভাঙ্গ দিন বাঁধনহারা॥’, ‘নব সৃষ্টির বুনিয়াদ হ’ল শুরু/ আমরা ক’জন কারিগর একসাথে/ গড়ি বুনিয়াদ একাগ্র সাধনাতে॥’, ‘ভুলি নাই, আজও ভুলি নাই।/ কলিজার খুন দিয়ে গেল যারা,/ বুকের আগুন দিয়ে গেল যারা,/ জিন্দানে যারা দিয়ে গেল রোশনাই॥’, ‘দয়া করো প্রভু ক্ষমা করো/ বান্দা যে গুনাগার।/তোমার করুণা নাহি পেলে / পাবে না সে পথ আর॥’’, ‘দুর্গম দূর মঞ্জিলে ফের যায় কাফেলা/ কা’বার পথে লক্ষ প্রাণের যায় কাফেলা॥’, ‘ও আমার/ মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা-/ খোদার সেরা দান/ বিশ্ব-ভাষার সভায় তোমার/ রূপ যে অনির্বাণ॥’, ‘আস্-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম।’ গানগুলো ফররুখ আহমদের বিশ্বাস, বোধ, দর্শন, দেশপ্রেম ও মানব হিতৈষী মনোভাবের সুর ফটে উঠে।
গানের স্বরলিপিও প্রকাশ পেযেছে গ্রন্থটিতে যেন সহজেই একে কণ্ঠ প্রদানের মাধ্যমে শ্রোতা হৃদয়ে পৌঁছে দেয়া যায়। তাঁর গাণের উল্লেখযোগ্র মূল্যায়নও সংযোযিত হয়েছে শেষাংশে। পরিশেষে একথা বলা অমূলক হবেনা ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মুহম্মদ মতিউর রহমানের অসম্পূর্ণ উদ্যোগকে সম্পূর্ণ করে তাওহীদুল ইসলাম বাংলা ভাষায় সঙ্গীতের শিকড়কে আরো শক্তিশালী জায়গায় নিযে গেছেন। গানের খেয়া থেকে প্রকাশিত ২৪০ পৃষ্ঠার বইটি নবদিগন্তের সূচনা হিসাবে শ্রমলব্দ কাজ হিসাবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।
তাওহীদুল ইসলাম সম্পাদিত ফররুখ আহমদ গীতি সংগ্রহ : গানের জগতে নতুন দিগন্ত_মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন

Recent Comments