বাবা আমার দিল মোহরে কাবা : ঝ) রোজায় ও ঈদে
বছর ঘুরে মুসলিম সমাজে দুটো ঈদ আসে।একটি ঈদুল ফিতর অন্যটি ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতরের আমেজ ও উত্সব শুরু হয় পবিত্র মাহে রমজানের শুরু থেকেই। আমার ছোট বেলায় দেখেছি পহেলা রমজান থেকেই আমাদের বাড়ির জামে মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় হোতে।আমরা ছোটরা যাদের নামাজ ফরজ হয়নি, তারাও তারাবির নামাজে শামিল হয়েছি। তারাবির নামাজে জুম্মার নামাজের মতো ভিড় হতো। আমরা ছোটরা আট রাকাত পড়েই মসজিদের বারান্দায় অনুচ্চস্বরে দুষ্টমিতে মেতে উঠতাম। এটা অনেকটা ছাড়পাওয়া ছিলো আমাদের। তবে ফাইনাল মোনাজাতে শরিফ হতাম।কেউ কেউ ঘুমিয়ে গেলে চোখ মুখ ধুয়ে মোনাজাতে যোগ দিতাম।
রোজারদিনে রোজাদারদের ভালো ইফতারী করানো হতো আমাদের বাড়ির মসজিদে আবার কখনও কখনও কাচারি ঘরের মেহমান খানায়। ইফতারিতে পানি অথবা লেবুর শরবত, পিয়াজু, বড়া, ছোলা ভোনা, জাউ ভাত বা খিচুড়ি কোন কোন দিন মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হতো। ফলের দিনে আম,কাঠালও দেয়া হতো। সেহরি ছিলো আরও মজার। আমাদের গ্রাম এলাকায় ষাটের দশকে সেহরিকে সরগাই খাওয়া বলতো। এই সরগাই আমরা খাওয়াতাম দশ বারো জনের এক এক গ্রুপকে পুরো মাস ব্যাপি। সরগাই খাওয়ার সদস্যরা ছিলেন আমাদের মহল্লার লোক। আবার কখনও কখনও ধান কাটার দাওয়াল বা কৃষকরা ছিলো এই সরগাই খাওয়ার নির্বাচিত সদস্য। আমার বাবা এদের সরগাই খাইয়ে পরম তৃপ্তি পেতেন। সরগাই খাওয়ার মেনু ছিলো জাজা স্বরপুটি মাছ বা টাটকিনী ভাজা মাছ,ঘন ঝোল করা, কই, মাগুর মাছ অথবা মৃগেল, রুই বা কাতলা মাছ এবং দুধ কলা ভাত। মহল্লার লোকেরা এই সরগাই খেতো পরম তৃপ্তিতে। অনেকে এ জন্য সারা বছর অপেক্ষা করত।
রমজানের শেষ দশকে যারা মসজিদে এতেকাফে বসত, তাদেরও আব্বা বিশেষ ভাবে ইফতার, তারাবি শেষে খাবার এবং সেহরিতে আপ্যায়ন করতেন। রমজানের শুরু থেকেই আমাদের নতুন জামা ও পাজামা বানানোর তোড়জোড় শুরু হতো। আমরা বাজারে যেতাম খলিফার নিকটে জামা পাজামার কাপড় পছন্দ করে শেলাই করার জন্য। আব্বা আমাকে কখনও কখনও নিয়ে যেতেন। কখনওবা আব্বা ফরিদ পুর শহর থেকে দামি শার্ট, প্যান্ট কিনে নিয়ে আসতেন। ছোট ভাই বোনদের জন্য আকর্ষণীয় জামা কাপড় কিনে আনতেন।
রোজার মাসের আর একটা বড়ো আনন্দ ছিলো দুস্হ ও গরীব দুখিদের জাকাত ফেতরা প্রদান। আমার আব্বাকে সেই ছোট বেলা থেকে দেখেছি জাকাত ও ফেতরার টাকা হিসেব করে গরীব জনতাকে প্রদান করতে। শুধু তাই নয় ওশরের অংশও গরীব মানুষকে দিতে দেখেছি। এ কাজে আব্বা একটি হিসেবের খাতা বানিয়ে ছিলেন। আমার দায়িত্ব ছিলো মহল্লার গরীবদের নাম তালিকা ভুক্ত করা। আব্বা জাকাতের টাকার একটি বড়ো অংশ মাকে দিতেন গরীব মহিলাদের মাঝে বিতরণ করার জন্য। মহিলারা রোজার মাস ভরে মার নিকট থেকে জাকাতের টাকা নিতে আসতো। মার নিজস্ব কিছু টাকা ছিলো যা থেকে মাও আলাদা জাকাতের টাকা দিতেন। আমি পুরুষদের মাঝে জাকাতের টাকা দিতে আব্বার সহযোগিতা করতাম অর্থাৎ জাকাত প্রাপ্তদের নামের পাশে মন্তব্যের ঘরে আদায় লেখতাম। আব্বাই আমাকে দিয়ে এ কাজ করাতেন। মাঝে মাঝে আমাকে দিয়ে জাকাতের টাকাটা প্রাপকের হাতে দেওয়াতেন। ফলে আমি গৌরব অনুভব করতাম এবং আমাকেও এভাবে জাকাত দিতে হবে তার দরদটাও বিপুল ভাবে উপলব্ধি করতাম। আব্বা এবং মা জাকাতের টাকা ছাড়াও ওই টাকা দিয়ে মহল্লার মহিলাদের বয়না মতো বিভিন্ন রঙের এবং ডিজাইনের শাড়ি কিনে দিতেন। সেই শাড়ি এবং পুরুষেরা লুঙ্গি পেয়ে দারুণ খুশি হতো।
জমির ওশরের ফসলও দশ ভাগের এক ভাগ এবং বিশ ভাগের এক ভাগ হিসেব করে গরীবদের আব্বা দরিদ্রদের মাঝে বন্টন করে দিতেন। ঈদের দু চার দিন আগে ফেতরার টাকাও হিসেব করে দেওয়া হতো। এ সব কাজে আঞ্জাম দিতে আব্বা আমার মার সাথে আলাপ করে নিতেন। আমি বড়ো ছেলে হিসেবে আমাকে আব্বা এই আনন্দময় ইসলামের একটি মৌলিক এবাদত সম্পাদন করতে জড়িত করতেন। ঈদগাহে নামাজের জন্য আব্বা আমাদের ভাইদের গোছল করে নতুন জামা পায়জামা টুপি পরে সুগন্ধি দ্রব্য মেখে প্রস্তুত হতে তাগিদ দিতেন। আমাদের ছয় আনি খারদিয়ার ঈদগাহ মাঠ আমদের মিয়াপাড়ায় আামাদের এবং অন্য একজনের জমিনে গড়ে উঠেছে। এটি আমাদের সাংসদ আমার ফুপু সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী উদ্বোধন করেছিলেন। এর পূর্বে অবশ্য ঈদগাহ মাঠ ছিলো ডাঙ্গীর বটতলায়।
আমার ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি আমাদের ঈদগাহে দুই ঈদের জামাত পড়াতেন এবং খোতবা দিতেন আমাদের খালাতো ভাই অধ্যাপক সাইয়েদ মোহাম্মদ আলী, যিনি বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের একজন খ্যাতনামা আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদ ছিলেন। কোন বছরে তার পরিবর্তে আমাদের গ্রামের দীঘি মহল্লার মাওলানা জনাব সামছুল হক, সাহেব ঈদের জামাতে নামাজ পড়াতেন। তিনি ইসলামি ফাউন্ডেশনের অনুবাদ বিভাগের ডাইরেক্টর ছিলেন। বর্তমানে আমার ছোটো ভাই হাফেজ মাওলানা শাহ হাবিবুল্লাহ এই ঈদগাহে ঈদের নামাজ ও খুতবা প্রদান করে। নামাজ শেষে কোলাকুলি হতো অনেকের সাথে। ঈদগাহের পাশেই ডাঙ্গীর বটতলায় আনন্দ মেলা হোত। আর একটি বিষয় লক্ষ্য করতাম চরপাড়ার বিশ্বাসবাড়ীর কালীপদ কাকা ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ঈদেগাহে হাজির হয়ে আমাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতেন। আব্বাকে প্রনাম করতেন। কালীপদ কাকা বাংলাদেশের যাত্রাদলের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তাদের পূর্ব পুরুষ অভয়চরণ বিশ্বাস আমাদের গ্রামের একজন প্রভাবশালী সমাজপতি ও ধনিলোক ছিলেন।
নামাজ শেষে বিকেলে আমাদের বাড়িতে মহল্লার লোকদের ঈদের বিশেষ আপ্যায়ন চলতো। মহল্লার ছোটো বড়ো, মধ্যবিত্ত, গরীব মিসকিন পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে কাচারি ঘরের মেহমান খানা,বাড়ির আঙিনায় সারিবেধে ঈদের আনন্দ খাবার খেতে বসে যেতেন। সে সময় আমাদের বাড়িতে এক মহৌত্সব শুরু হোত। পোলাও, মোটা চালের ভাত, মুরগীর গোস্ত, ক্ষির বা পায়েশ দিয়ে তাদের পরম যত্নে খাওয়ানো হতো।মহিলারা অন্দরমহলের আঙিনায় বসে সারিবদ্ধ ভাবে ঈদের খাবার গ্রহণ করতেন। মহল্লার জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং সম্ভাব্য ঝামেলা এড়াতে পরবর্তীতে তাদেরকে ঈদের দিনে শুধু ক্ষির বা পায়েশ দিয়ে আপ্যায়ন করা হোত।
কোরবানির ঈদে গরুর গোস্তের তিন ভাগের এক ভাগ মহল্লার লোকদের মধ্যে সমবন্টন করা হোত। গরু অবশ্য কয়েকটি কোরবানি দেওয়া হতো। ঈদের পরের দিন মহল্লার লোকদের সাদা ভাত ও গরুর রেজালা দিয়ে খাওয়ানো হতো। আব্বা এসময়ে খুব আনন্দ লাভ করতেন। পরবর্তীতে শুধু মাতুব্বর শ্রেনীর লোকদ আলাদা আপ্যায়ন করা হতো। অনেক গরীবলোককে আমার মা গরুর গোস্ত দিয়ে ভাত খাওয়াতেন। এখন শুধু গরুর গোস্ত বন্টন করা হয়। গরীবদেরকে সম্ভাব্য পরিমানে আপ্যায়ন করা হয়। ঈদের দিনে আমাদের বাড়িতে কোন ভেদাভেদ থাকে না। আমি এ বিষয় টি দারুণ ভাবে উপভোগ করতাম। আমার শিশুতোষ লেখায় এর কিছুটা সুগন্ধি পাওয়া যায় :
ঈদ
বছর ঘুরে এলো খুশির ঈদ,
নোলক পরা বুবুর মত চাঁদনি হাসির হৃদ।
আকাশ ছেড়ে বাতাস ছেড়ে
এলো সবার ঘরে,
খুশির জোয়ার বান ডেকেছে
শুকনো নদীর চরে।
তিরিশ রোজার শীর্ণডালে কুসুম ফুটেছে
বাঁকা চাঁদের হীরক ঝরে হৃদয়৷ ভরেছে।
নতুন জামা নতুন কাপড়
আতর গোলাপ পানি
খোশবু বাহার স্বাদের খাবার
আনন্দ ঝলকানি।
ঈদের এমন দিন
আমির ফকির কোলাকুলি
সাম্য অমলিন।
একটি দিনের জন্য সবাই দারুণ ইন্তেজার
এক জামাতে বিশ্ব মানুষ হোক না একাকার।
Recent Comments