হৈমন্ত রারাং-এর বাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে জোনাকি পোকার রহস্য নিয়ে ভাবছিলো। আইল থেকে রাস্তায় উঠবে তখন আলো-আঁধারে কয়েকজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। তাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে গেলো মাটিতে। প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিতে নিতে বেশ কিল-ঘুষি খেতে হলো ওকে। দূর্বৃত্তরা কোন কথা না বলে ওকে ধোলাই দিয়ে গেলো চলে। আয়েজ দাঁড়িয়ে পুরো গা ছুঁয়ে অনুভব করতে চাইলো কোথাও রক্তপাত হয়েছে কিনা। মনে হচ্ছে হয় নি। ভোঁতা আঘাতগুলো ব্যথায় ভোগাবে বেশ কিছুদিন যদি না ব্যথানাশক ঔষধ সেবন করা হয়। ডাকবাংলোর পেছনের জঙ্গলের কাছে এসে ফের বিস্ময়ে হতবাক আয়েজ। পুরো জঙ্গলে একটা দুইটা জোনাকি আলো জ্বাললেও ভেতরে একস্থানে অনেক জোনাকি পোকা হৈমন্ত রারাং-এর বাড়ির মতো করে রেখেছে আলোকোজ্জ্বল।
আয়েজ আজিজ সেখানেই দাঁড়িয়ে ভাবছে: ডাকবাংলোর জোনাকি পোকা, হৈমন্ত রারাং-এর বাড়ির জোনাকি পোকা আর এই জঙ্গলের ঐ জোনাকি পোকার মধ্যে কোনো রহস্যময় সম্পর্ক আছে কি? কেনো ঐ স্থানে এতো জোনাকিপোকা আলো জ্বালছে, দেখা যাক।
আয়েজ ভেতরে ঢুকার জন্য পা বাড়াবে তখন কয়েকজন মুখোশধারী ওর পথ রোধ করে দাঁড়ালো। আবার মারপিট? এবার একচেটিয়া মারপিট খাবে না ও-প্রতিপক্ষ একাধিক হলেও এক/দুইজনকে কয়েক ঘা তো লাগাতেই পারবে। আঘাতের পূর্বে নয় প্রত্যাঘাত-এই নীতি মেনে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছে প্রথম আঘাত আসার।
তখন একজন বললো, তপতীর নিখোঁজের বিষয়ে আর কোন খোঁজাখুঁজি না, কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ না। আমার কথা না মানলে মারপিট না, তপতীর মতো নিখোঁজ করে দেবো আপনাকেও!
তাহলে আজ আর দ্বিতীয়বারের মতো ধোলাই দেবে না ওকে। সে গায়ের পেশি শিথিল করে বললো, তাহলে আপনারাই তপতীকে নিখোঁজ করেছেন? কেনো এমন জঘন্য কাজটা করেছেন বলবেন কি?
এতো কিছু জানার প্রয়োজন নাই আপনার। এই বিষয়ে আর কৌতুহল দেখালে আপনাকে দূর্গাপুর ছাড়তে হবে।
আচ্ছা আপনি এতোদিন দূর্গাপুর কী করছেন বলুন তো?
আয়েজ বিস্ময়ের ভান করে বললো, এতোদিন কোথায়! মাত্র তো দুই দিন হলো! আর দুই তিন থাকবো।
কী কাজ আপনার এখানে? কী করছেন আপনি?
স্রেফ বেড়াতে এসেছি! নেত্রকোণায় অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। আপনারা কি দেখেছেন ওসব? প্রবাদে আছে মক্কার মানুষ হজ্জ্ব পায় না!
বেশি কথা বলছেন আপনি! সোজা ডাকবাংলোয় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। মনে রাখবেন এখন থেকে আমরা আপনাকে চোখে চোখে রাখবো।
তথাস্তু!
আয়েজ আজিজ জঙ্গলের ভেতরের জোনাকি পোকার অত্যাধিক আলোকিত স্থানটা আড়চোখে একবার দেখে ডাকবাংলোয় ঢুকার রাস্তা ধরলো। একটা কথা মনে হতেই দ্রুত হেটে চলে এলো ডাকবাংলোয়। ডাক শুনে চৌকিদার রবার্ট সিধু এলে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাছে কয়টা টর্চলাইট আছে রবার্ট সিধু?
রবার্ট সিধু বললো, তিনটা। পুরা চার্জ করা আছে ছার।
নিয়ে আসো। পুলিশ না আসা পর্যন্ত জঙ্গলের একটা জায়গা আমাদের পাহারা দিতে হবে।
রবার্ট সিধু কিছু না বলে দৌড়ে চলে গেলো ভেতরে। একটু পরই ফিরে এলো তিনটা চর্ট নিয়ে। দেড় ফুট লম্বা প্রতিটি টর্চ। চার্জার টর্চ হওয়ায় এগুলো আলোর অনেক তীব্র ফোকাস দেয়।
দুইটা টর্চ লাইট রবার্ট সিধুর হাতে দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে অধিক জোনাকি পোকা জ্বলা জায়গাটা দেখিয়ে আয়েজ আজিজ বললো, দুইটা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ঐ অধিক জোনাক পোকা জ্বলা জায়গাটায় ফোকাস করে রাখো।
আমিও করছি।
বলে আয়েজ আজিজ নিজ হাতের টর্চ লাইটটা জ্বালিয়ে ফোকাস করলো ওদিকে। সাথে সাথে রবার্টও দুটো টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ওদিকে ফোকাস করলো। জায়গাটা পূর্ণ চাঁদের আলোর চেয়েও বেশি উজ্জ্বল হলো।
আয়েজ পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে নেত্রকোণা জেলার পুলিশের তত্বাবধায়ককে ফোন করলো।
বললো, স্যার, আমি আয়েজ আজিজ। প্রাইভেট ডিডেক্টিভ।
পুলিশের তত্বাবধায়ক ফকরুল আমিন বললেন, গুড গড! নিশ্চয়ই আপনি নেত্রকোণায় নন?
জ্বি স্যার, আমি এখন নেত্রকোণার দূর্গাপুরে।
থ্যাংক গড! নিশ্চয়ই বেড়াতে এসেছেন?
বেড়াতেই এসেছিলাম স্যার। একটা কেস হাতে নিতে হয়েছে। এখনই পর্যাপ্ত ফোর্স দরকার। নাহলে লাশ চুরি হয়ে যেতে পারে। ডিটেইলড পরে বলবো স্যার।
দূর্গাপুরের ওসিকে বলছেন না কেনো?
আমার ধারণা ওসি সাহেবও ইন্টারেস্টেড হয়ে গেছেন।
কোন কেসটা?
তপতী নিখোঁজ কেস।
আপনি কী করেছেন?
সম্ভবতঃ আমি লাশের সন্ধান পেয়ে গেছি। এখনই পুলিশ না এলে ওরা লাশ উঠিয়ে নিয়ে যাবে। পুলিশ লাইন থেকে এক ট্রাক পুলিশ পাঠিয়ে দূর্গাপুর থানার ওসিকে বলে দিন সাপোর্ট দেবার জন্য। মেক ইট টেক্টফুল্লি স্যার।
ওকে। আপনার উপর পুলিশ বিভাগের যথেষ্ট ফেইথ আছে। সেই বিশ্বাসেই পুলিশ ফোর্স পাঠাচ্ছি।
থ্যাংক ইউ স্যার।
মোবাইল ফোনের লাইন কাটতেই রবার্ট সিধু জিজ্ঞেস করলো, কী কইলেন ছার। কিছুই তো বুঝতাম পারতাছি না।
আয়েজ বললো, এখন বেশি বুঝতে হবে না। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঐ জায়গাটা পাহারা দাও। সাবধান!
আয়েজ আজিজ নিজের টর্চটা জ্বালিয়ে রেখে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঐদিকে।
জোনাকি পোকায় আলোকিত ঝোপের পাশের ঝোপটা সামান্য নড়ে উঠতেই সিধু উত্তেজিত কণ্ঠে বললো, ওই ঝোপের পাশে কেডা? আর আগাইবি না! আগাইলে বল্লম ছাড়বাম।
আয়েজ আজিজ বললো, সিধু, ঝোপের কাছে চলো। তোমার ছেলেকেও আসতে বলো। আমাদের দল ভারি হোক।
আয়েজ ও সিধু ছুটে চলে এলো ঝোপের কাছে। একটু পর সিধুর দুই ছেলেও ওদের পাশে এসে দাঁড়ালো।
আধা ঘন্টা পর দুটো পিকাপ ভর্তি করে চলে এলো পুলিশ। দূর্গাপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর সিরাজ হায়দার আয়েজ আজিজকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে এতো রাতে এখানে? কী সমস্যা আয়েজ সাহেব?
আয়েজ বললো, এখানে সম্ভবত একটা ডেডবডি আছে।
সম্ভবত মানে?
আমি খুড়ে দেখি নাই। পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝতে পারছি এখানে ডেডবডিটা আছে।
কার ডেডবডি?
লাশটা উঠালেই বুঝা যাবে। রবার্ট সিধু কাজে লেগে যাও। এই কাজের জন্য আলাদা পারিশ্রমিক পাবে।
আয়েজ আজিজের মোবাইল ফোনে কথাবার্তা শুনে রবার্ট সিধুও উত্তেজিত। দুই বছর হয়ে গেলো ওর এক স্বজাতি মেয়ে গায়েব হয়ে গেলো। এই লোকটা ঐ মেয়েটার লাশ বের করতে যাচ্ছে। আহা রে, মেয়েটারে কত কষ্ট দিয়ে খুন করেছে পিশাচরা! মেয়েটার গায়েব হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য ও অবশ্যই আয়েজ আজিজকে সহযোগিতা করবে! রবার্ট সিধুর দুই ছেলে মাইকেল ও সাইরাস দ্রুত চলে গেলো ডাকবাংলোয় ওর কোয়ার্টারের দিকে। দু’জনে দুটো কোদাল নিয়ে ফিরে এলো তিন মিনিটেই। অনেক উৎসাহে রবার্ট সিধুর দুই ছেলে শুরু করলো মাটি কোপানো।
আয়েজ আজিজের হৃৎস্পন্দন কিছুটা বেড়ে গেছে। যদি কিছুই পাওয়া না যায়? এই আলো নিছক জোনাকি পোকার খেয়াল? তখন কিভাবে সামাল দেবে? তখনই নাকে পঁচা গন্ধ লাগায় ভ্রু কুচকে আশাবাদি হয়ে উঠলো আয়েজ।
এসআই সিরাজ হায়দার নাক টেনে পঁচা গন্ধ শুঁকে নাকেমুখে হাত চাপা দিয়ে বললো, এই পঁচা গন্ধ কিসের?
আলো-আঁধারে ভ্রু নাচিয়ে আয়েজ আজিজ বললো, বলেছিলাম না সিরাজ ভাই এখানে ডেডবডি আছে! এখন প্রমাণ পাচ্ছেন তো? দুই বছর আগের ডেডবডি, তাই লাশ শুকিয়ে শুটকির মতো হয়ে গেছে।
নতুন তার ও বাল্ব কিনে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হলো। লাশের পরনের কাপড় ও কঙ্কাল দেখা গেলে খুঁড়াখুঁড়ি থামিয়ে দিয়ে আয়েজ বললো, আনাড়ি হাতে আর খোড়া ঠিক হবে না। এখন ফরেনসিক বিভাগকে আসতে বলেন সিরাজ ভাই ।
এসআই সিরাজ হায়দার তখনই মোবাইল ফোনে ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞদের দ্রুত আসতে বললো দূর্গাপুরে।
এসআই সিরাজ আয়েজকে বললো, খবরটা ওসি সাহেবকে দেয়া দরকার।
আয়েজ আজিজ বললো, ওসি সাহেবকে বলতে চাচ্ছেন? বলুন।
দূর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওবায়েদ আকাশ এসআই সিরাজের কাছে লাশ পাবার সংবাদ শুনে প্রথমে চমকে উঠলেও সামলে নিয়ে আয়েজ আজিজের সাথে কথা বলতে চাইলে সিরাজ মোবাইল ফোনটা আয়েজের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, ওসি স্যার আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন।
আয়েজ এসআই সিরাজ হায়দারের হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে বললো, আসসালামু আলাইকুম ওবায়েদ ভাই। কেমন আছেন?
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওবায়েদ আকাশ বিরক্ত স্বরে বললেন, মিস্টার আয়েজ, আপনি কবে এসেছেন এখানে? আমার অনুমতি না নিয়ে আপনি এখানে ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছেন? কিসের লাশ পেয়েছেন আপনি?
লাশটা সম্ভবত একজন মানুষের। পোস্টমর্টেম ও কোনো আলামত পাওয়া না গেলে বলা যাবে না লাশটা কার।
ডাকবাংলো তো থানার কাছেই। আপনিও চলে আসেন ওসি সাহেব।
অবশ্যই আসছি! আপনি লাশ না অন্যকিছু পেয়েছেন এটা দেখতে হবে না?
আয়েজ আজিজ আর কিছু না বলে মুখ টিপে হেসে মোবাইল ফোনের লাইন কেটে ঢুকিয়ে রাখলো পকেটে।
সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লাশ থাকা গর্তের দিকে। মনে প্রশ্ন: লাশটা কি সত্যিই তপতীর? নাকি অন্য কারো? তাহলে তপতী কোথায়? নাহ! লাশ তুলে গর্তে থাকা কাপড়চোপড় দেখে লাশটা কার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।
দূর্গাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওবায়েদ আকাশ এসেই শুরু করলেন হম্বিতম্বি।
প্রথম ধমকটা গেলো রবার্ট সিধুর উপর। ‘তুই কাউকে খুন কইরা এখানে পুইত্যা রাখছস! ক, কারে খুন করছস?
আয়েজ আজিজ রবার্ট সিধুকে একবার দেখে বললো, লাশটা আগে উঠুক ওসি সাহেব। এখানে যেসব আলামত পাওয়া যাবে সেগুলো দেখে প্রাথমিকভাবে বুঝা যাবে কে খুন হয়েছে এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলে দিবে কিভাবে খুন হয়েছে।
তখন ফরেনসিক বিভাগের লোকজন চলে আসায় ওবায়েদ আকাশ ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওদের সাথে। পুলিশের তিন সাব-ইন্সপেক্টর হাতে শাদা গ্লভস পরে নেমে পড়লো মাটি খুঁড়ায়। আরেকজন তুলতে শুরু করলো ছবি। রুদ্ধশ্বাসে সবাই দাঁড়িয়ে আছে গর্তের চারদিকে। ওরা খুব সতর্কতার সাথে খুঁড়ছে মাটি। মরদেহ এখনো পঁচে মিশে যায়নি মাটিতে। উৎকট পঁচা দুর্গন্ধ বের হতেই সবাই পকেট থেকে রুমাল বের করে চাপা দিলো নাকে। পরনের কাপড় এখনো পঁচে যায়নি।
গর্তে থাকা একজন সাব-ইন্সপেক্টর বললো, গায়ের ড্রেসটা এখনো পঁচে নাই আয়েজ ভাই। মনে হচ্ছে স্কুল ড্রেস।
আয়েজ আজিজ বললো, এটা স্কুল ড্রেস না, কলেজ ড্রেস। দেখুন তো নাজির ভাই, নেম-ট্যাগটা আছে কিনা ড্রেসের সাথে।
একটু পর এসআই নাজির নতুন কিছু আবিস্কার করে ফেলেছে এমন উল্লসিত কণ্ঠে বললো, একটা নেম-ট্যাগ পাওয়া গেছে আয়েজ ভাই!
কী নাম সেটা?
তপতী রারাং।
তাহলে আমার সন্দেহটাই সত্যি হলো।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওবায়েদ দ্রুত বললো, সেকারণেই তো মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। কারা এই কাজটা করলো?
আরেক এসআই রাজীব বললো, মাথার খুলির পেছনটা ডাবা। মনে হচ্ছে রড জাতিয় কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। সম্ভবত এই আঘাতের কারণেই মেয়েটার মৃত্যু হয়েছে।
আয়েজ আজিজ বললো, এতোদিন হয়ে যাওয়ায় এখন আর বুঝা যাবে না খুন করার আগে তপতী রেপড হয়েছিলো কিনা।
ততক্ষণে হৈমন্ত রারাং সহ আটপাড়া ও আশেপাশের গ্রামে তপতীর লাশ পাবার খবরটা হয়ে গেলো রাষ্ট্র।
ভালোবাসার ছিন্ন সরোবর_রানা জামান : পর্ব-৮

Recent Comments