কবিতার প্রাণধর্ম অনুসারে বাংলা কবিতার প্রবহমান ইতিহাসে অনেকগুলো বাঁকবদল ঘটেছে। সাধারণত সমাজ ও সংস্কৃতিতে বড় ধরনের ভাববিপ্লব, কর্মপ্রচেষ্টা ও পরিবর্তন কবিতার প্রচলিত স্রোতকে অন্যদিকে ঘোরায়, ফেরায়, বহায়। নতুন ধারাসৃষ্টির সময়ে মৌলিক কিছু কবির সৃষ্টি সেই কালকে আলোকিত ও সৃজনমুখর করে তোলে। চণ্ডিদাস, শাহ মোহাম্মদ সগীর, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, আলাওল, ভারতচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, আবু হাসান শাহরিয়ার, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা কবিতার সেইসব মৌলিক ও স্বতন্ত্র কাব্যপ্রতিভা। কবি- মৌলিক, সৃষ্টিশীল, আপন আলোয় দীপ্ত- মহৎ শিল্পী।
বাংলাদেশের কবিতা সাতচল্লিশের দেশবিভাগের পর পালটে যেতে থাকে নতুন স্বপ্ন, সম্ভাবনা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে এবং ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন এক সমাজ ও সাহিত্য নির্মাণের প্রত্যয় ও প্রচেষ্টায়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাংলা কবিতার সেই স্রোতকে নতুন ধারার সন্ধান দেয় এবং সঞ্জীবনী শক্তিতে বেগবান করে তোলে। পরবর্তীকালে স্বাধীকার আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামের ঝড় হাওয়ায় জনজীবনের রূপরঙের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কবিতায়ও সার্বিক রূপান্তর সম্পন্ন হয়। নজরুলের কাব্যজগতের যে ধারাটি আস্থা ও বিশ্বাসের এবং স্বজাতিক ঐতিহ্যের, তাকে একটি সুসম্পন্ন, পূর্ণাঙ্গ ও সমৃদ্ধ রূপ দেন ফররুখ আহমদ। এই প্রবাহকে আরো গভীর, বিস্তৃত ও প্রবল করে তোলেন আল মাহমুদ। বাংলাদেশের কবিতায় আশির দশকে এই ধারার একজন শক্তিমান ও মৌলিক কবিপ্রতিভার আগমন ঘটে- মতিউর রহমান মল্লিক সেই কবির নাম। এই কবিকে আল মাহমুদ অভিহিত করেছেন ‘অন্তরাল পরায়ণ কবি’ ও ‘কোলাহল বিমুখ কাব্যপ্রতিভা’। নাগরিক, প্রতিহিংসা পরায়ণ, প্রচারমুখী সাহিত্যসমাজে এ ধরনের কবি সুস্থভাবে বিকশিত হতে পারে না; তাকে তাই আড়াল ও নির্জনতার খোঁজ করতে হয়- নীরবে, নিভৃতে, আপন খেয়ালে কাব্যচর্চা করার জন্যে। কবিতার স্রোত গতিশীল থাকে মূলত এই স্বভাবের কবিদের কৃতিতে। অর্থাৎ ‘সাহিত্যের প্রাণশক্তি’ এইসব কবিই- যাদের কাব্যজীবন ও কাব্যসাধনা ব্যয় হয় কবিতার জন্যে।
‘আস্থা ও বিশ্বাসের স্বতন্ত্রধারা’ নির্মাণে মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা কবিতায় একটি মৌলিক কণ্ঠস্বর। মহৎ আদর্শ, সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও বিশ্বাস যেসব কবি জীবনের মৌলভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন তারা সাধারণত হয়ে থাকেন রোমান্টিক কবি। রবীন্দ্রনাথ থেকে আল মাহমুদ পর্যন্ত এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়। পরবর্তী দৃষ্টান্ত মতিউর রহমান মল্লিক। প্রথম কাব্যগ্রন্থ আবর্তিত তৃণলতা (১৯৮৭) এই সাহিত্যাদর্শে উজ্জীবিত ও শিল্পসৌন্দর্যে মণ্ডিত। নিজস্ব কাব্যভাষায় কবি এই বইয়ে মূলত সত্য, মঙ্গল ও সুন্দরের গীতিকাব্য রচনা করেন; স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ, সরল অনুভূতি ও তীব্র বিশ্বাস এখানে প্রতিফলিত। মাঝে মাঝে আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস লক্ষণীয়: ‘আমি খুব সহজেই উন্মাতাল হই/ ভেংগে পড়ি অথবা উজ্জীবিত হই’। [আমি: আবর্তিত তৃণলতা] এই গ্রন্থে এবং পরবর্তী সব কাব্যে তাঁর প্রধান বিষয় প্রকৃতি। প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান সৌন্দর্য, দর্শন ও সত্য কবিকে মুগ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশি। ‘বাঙা মাটির সন্ধ্যা’, ‘অপার্থিব সবুজ বাসীর কথা’, ‘একটি হৃদয়’, ‘কৃষ্ণচুড়া’, ‘গাছ সম্পর্কিত’, ‘নদী এক নদী’, ‘নদীর কাছে’, ‘সৌন্দর্য সামলানোর ক্ষমতা’, ‘ক্রমাগত’- আবর্তিত তৃণলতার এইসব কবিতা মূলত প্রকৃতিকেন্দ্রিক। অনবরত বৃক্ষের গানের ‘বোরকাধারয়িতা ও দারুবৃক্ষের স্তোত্র’, ‘হেমন্ত দিন’, ‘তুলনা’, ‘কবিতার ধ্র“ব’, ‘কাশ-শিউলির সময়’, ‘ঋতুর স্বভাব’, ‘আর এক সূর্যের গান’, ‘বিলের দিকে’ কবিতাবলিও নিসর্গময়। ‘একটি হৃদয়’ কবিতায় হৃদয়ের উপমা দিতে কবি বিস্তীর্ণ প্রকৃতির মাঝে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। উপমা সংগ্রহে কবির ‘প্রকৃতিপ্রেমিক’ সত্তার পরিচয় মেলে। এই পরিচয় আরো বেশি গাঢ় হতে থাকে উত্তরজীবনের কাব্যে। কাব্যগ্রন্থের নাম দেখেই অনুভব করা যায় তাঁর প্রকৃতিবাদীতা: আবর্তিত তৃণলতা, অনবরত বৃক্ষের গান, চিত্রল প্রজাপতি ও নিষণ্ন পাখির নীড়ে। তবে প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থ সবচেয়ে বেশি প্রকৃতি প্রভাবিত। কবির প্রকৃতিচেতনার মূলে কাজ করেছে বাগেরহাটের সবুজ শ্যামলিমায় শৈশব ও কৈশোরকালীন অভিজ্ঞতা এবং সমগ্র বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতিতে ভ্রমণের স্মৃতি। ফলে প্রাকৃতিক পটভূমি তাঁর কবিতাকে অধিকার করেছে তীব্রভাবে; আর সেখানেই তিনি সুন্দরের পঙ্ক্তিমালা সৃজন করেন। অর্থাৎ প্রকৃতিকে কবি দেখেছেন দুইভাবে: নান্দনিক ও দার্শনিক দৃষ্টিতে। কবি নান্দনিক ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু, অলঙ্কার ও পটভূমি হিসেবে নিসর্গের ব্যবহার করেছেন, এই ব্যবহারে কবি স্বাতন্ত্র্য ও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন নিঃসন্দেহে।
কবির প্রকৃতিচেতনায় মূলত শ্যামল বাংলাদেশ প্রতিবিম্বিত। বিশেষভাবে দক্ষিণ বাংলার সবুজাভ নিসর্গ বাক্সময় হয়ে উঠেছে। বৃক্ষ, নদী, পাখি, সাগর, বৃষ্টি তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গ। উপমা বা ইমেজ সৃষ্টিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো। এক্ষেত্রে কবির প্রকৃতিপ্রেম ও দেশপ্রেম ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। তিনি অন্য কোন দেশের নয়, বাংলাদেশের নিসর্গ ভালোবেসে কাব্যে ধারণ ও অঙ্কন করেন। সেদিক থেকে তাকে দেশপ্রেমিকরূপে চিহ্নিত করা যায় সহজে। কবি শুধু স্বদেশের গ্রামীণ নিসর্গপ্রীতির পরিচয় দেননি। প্রকৃতিলগ্ন মানুষের কথাও করেছেন। তবে গ্রামীণ মানুষের কথা জসীমউদ্দীন বা আল মাহমুদ যেভাবে এঁকেছেন, সেভাবে মল্লিক আঁকেননি। বরং তিনি নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষের কথকতা দরদ সহকারে রূপায়িত করেছেন। প্রকৃত অর্থে তাঁর স্বাদেশিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নিসর্গচেতনায়।
কাব্যচর্চার প্রথম থেকেই কবি রাজনীতি সচেতন। কবির রাজনীতি প্রবাহিত হয়েছে তিনটি সড়কে- ক. আদর্শ, খ. জাতীয় স্বার্থ, গ. পরদেশী আগ্রাসন। তিনি সেইসব কবিদের অন্তর্গত যারা জীবন ও কবিতাকে অভিন্ন ভাবেন। কবিজীবন ও ব্যক্তিজীবন পৃথকভাবে দেখেন না, অঙ্কন করেন নাÑ একই আদর্শের দুটি প্রবাহিত ধারা। কবির জীবনাদর্শ ইসলাম। তাই ইসলামের সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের কথা নানা ইমেজে কবি ধারণ করেছেন। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমকালীন ঘটনাবলী থেকে কবি আহরণ করেন বিষয়ের প্রয়োজনীয় উপাদান। সেজন্যে কবির তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর অনুভব করা যায় এই আদর্শের বিরুদ্ধবাদীদের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে কবি স্বদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে যেমন তৎপর, তেমনি স্বার্থ-সম্পদ বিকিয়ে যারা দেয় তাদের বিরুদ্ধেও কলমযোদ্ধা।
সে কারণে কবি পদ্মার পানি প্রবাহে প্রধান বাধা যে ফারাক্কা বাঁধ সে সম্পর্কে প্রতিবাদী, ট্রানজিট বিষয়ে সোচ্চার এবং বিভিন্ন দেশবিরোধী চুক্তি, কর্মকাণ্ড বা তৎপরতার ব্যাপারে আপসহীন। স্বদেশের অস্তিত্ব রক্ষায় তাই কবিকে মাঝে মাঝে উচ্চকণ্ঠ হতে হয়েছে। এক কথায়, কবি দেশের প্রতি দায়বদ্ধ- স্বদেশের স্বার্থরক্ষা ও সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির আগ্রাসন প্রতিহত করার প্রত্যয়ের মাঝে কবির রাজনীতি বিরাজমান। সেই প্রেরণা কবি মাঝে মধ্যেই পেয়েছেন ‘চিরউন্নত শিরে’র কবি নজরুলের কাছ থেকে। এদিক থেকে মল্লিককে উপনিবেশিক শক্তিবিরোধী কবিরূপে চিহ্নিত করা যায় অনায়াসে। আর তিনি যেহেতু আপাদমস্তক বাংলাদেশের কবি, সেজন্যে এ দেশের জনগণের পক্ষে, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পক্ষে, তাদের মুখের ভাষা ও ভঙ্গি ধারণ করেছেন। তাঁর মাঝে তিরিশের পরজীবী উত্তরাধিকার নেই; ফলে তিনি উত্তর-ঔপনিবেশিক কবি হতে পেরেছেন সহজে। অর্থাৎ জনগণের কবি, কেননা তিনি গণমানুষের কাছে দায়বদ্ধ। এই কমিটমেন্ট পাওয়া যাবে তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিমালায়।
কবির রোমান্টিক সত্তার যে স্ফূরণ আবর্তিত তৃণলতায় ঘটেছে, তার পরিণতি লক্ষ করা যায় নিষণ্ন পাখির নীড়ে। যেমন গীতিময়তা (Lyric) তাঁর কবিতায় আগাগোড়া ক্রিয়াশীল। সাঙ্গীতিক প্রভাব তাই অনুভব করা যায়। অন্যদিকে কল্পনা (Imagination) ও স্বপ্ন (উৎবধস) বিপুলভাবে স্পন্দিত। বর্তমানের দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের স্বপ্ন তাঁর কবিতায় বারবার ঝংকৃত। সাথে সাথে কাব্যনির্মাণ শৈলীতে নানা ইমেজ কল্পনার ডানা ঝাপটিয়েছে অক্লান্তভাবে। তাঁর গীতিময়তা সম্পর্কে বলা যায় যে, গীতিকাব্যেরই একটি উর্বর শাখা হলো তার সঙ্গীত- সৃজনের অন্য ফসল, অন্য উৎসারণ। এছাড়া তাঁর গান কবিতা হিসেবেও উপভোগ্য। তাই তাঁর কবিসত্তার বিচারে সঙ্গীতকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, নজরুল কাব্য বিচারের মতো। নজরুলের মতো তাঁর অনেক গান কবিতার মতো এবং বহু কবিতা গানের মতো।
একজন মৌলিক কবি হওয়ার প্রধান শর্ত হলো নিজস্ব কাব্যভাষা (Diction) নির্মাণ। কাব্যভাষা সৃষ্টি হয় মূলত তিনটি উপায়ে- জীবনদর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনাভিজ্ঞতা ও পাঠপ্রক্রিয়া। এই বিষয়গুলোর সমন্বয়ে সৃজিত হয় নতুন এক কাব্যভাষা। এদিক থেকে মতিউর রহমান মল্লিক একজন সফল কাব্যশিল্পী। কেননা তিনি প্রথম জীবন থেকেই আপন কাব্যভাষা উপার্জন করে নেন। আদর্শবাদী জীবনদৃষ্টি, ভ্রামণিক অভিজ্ঞতা ও নানামাত্রিক পাঠাভিজ্ঞতা তাকে স্বাতন্ত্র্যের মাত্রা দিয়েছে।
আমি সৌন্দর্যের অন্তর অবধি পৌঁছেই
সহগামীকে চুপ করতে বললাম
অখণ্ড নীরবতার মধ্যে অতলান্ত কলতান
শুনতে দাও
বললাম
উলংগ এক পার্বত্য শিশুর
পর্বতের গা বেয়ে উঠানামা দেখতে দাও,
নিুতম প্রদেশ থেকে খণ্ডিত আকাশকে
ভাবতে দাও
[সৌন্দর্য সামলানোর ক্ষমতা : আবর্তিত তৃণলতা]
এমন কাব্যভাষা আশির দশকের অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদা আঙ্গিকে নির্মিত। রোমান্টিক ভাবাদর্শে ব্যঞ্জনা লাভ করায় তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে উপভোগ্য শিল্পসম্ভার। তাঁর কাব্যভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো স্বতঃস্ফূর্ততা, গীতলতা ও সাঙ্গীতিক আবহ। স্বচ্ছতা থেকে সাবলীলতা, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহারের জন্য গীতিময়তা এবং সুরের ছোঁয়ার কারণে গানের আবহাওয়া অনুভব করা যায় তাঁর কাব্যে। গদ্যকবিতা বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে তাঁর কবিতার বইগুলোতে। ধরাবাঁধা কোন ছন্দ নেই কবিতাগুলোয়। তবুও আশ্চর্য সাবলীলতা ও অন্তরালবর্তী এক ধরনের স্পন্দন টের পাওয়া যায় সেখানে। মনে হয়ে ছন্দেসুরে বাঁধা সেইসব পঙ্ক্তিমালা। এখানেই গদ্যকবিতার বিজয়। তবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ না থাকায় একটা উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে, তা অনস্বীকার্য।
আর একটি বিষয় তাঁর কবিতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উচ্চার্য: শব্দ ব্যবহারে সচেতনতা ও নতুনত্ব। কবিতায় তাঁর শব্দ প্রয়োগ একান্ত নিজস্ব। অনেক গদ্যগন্ধি, অপ্রচলিত শব্দ তিনি কবিতায় ব্যবহার করেন অবলীলায়। প্রচলিত শব্দসম্ভার থেকে আপন শৈলীতে শব্দকে গ্রহণ করেন কবি। যেমন, একটি শব্দ ‘দেবদারু’। তিনি একে ব্যবহার করেন ‘দারুবৃক্ষ’ হিসেবে, বোঝা যায় আদর্শিক কবি ‘দেব’ শব্দটি প্রয়োগ করতে চাননি। এভাবে শব্দের সংস্কার প্রক্রিয়ায় কবি ভূমিকা রাখেন। উৎসগত দিক থেকে কবি সংস্কৃত, তদ্ভব ও অর্ধতৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন বেশি। তিনি মূলত বাংলাদেশের কাব্যভাষায় বাংলাদেশের কবিতা রচনা করেছেন। আর স্বদেশ থেকেই গ্রহণ করেন অসামান্য সব উপমা, ইমেজ, প্রতীক। গাছ বা বৃক্ষ কবির প্রিয় অনুষঙ্গ। প্রচুর কবিতায় কবি একে ব্যবহার করেন। বৃক্ষের জীবনবৃত্তান্ত কবিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে।
উপমাদি বা ইমেজ নির্মাণে কবি সবুজ শ্যামল দক্ষিণ বাংলাকে নির্বাচন করেছেন। সবুজ ফসলের মাঠ-প্রান্তর, বন-বনানী, জলজ উদ্ভিদ, তৃণলতা-বৃক্ষ এবং নদী-সাগর হয়ে উঠেছে তাঁর কাব্য উপাদান। অধিকাংশ কবিতার ভিত্তিভূমি তৈরি হয়েছে দক্ষিণ বাংলার প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রেক্ষিতে। এদিক থেকে তিনি চিত্রশিল্পীর কারুকাজ ও দৃষ্টি ব্যবহার করেন নানা রঙ-রেখা-চিত্রের সমন্বয়ে। অর্থাৎ কবিতাকে শিল্প উপযোগী করে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কবি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
কবি হিসেবে মতিউর রহমান মল্লিক যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, মানুষ হিসেবে মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন আরো বেশি। মানুষ হিসেবে তিনি প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন; তাঁর উদারতা অকৃত্রিম ও সুগভীর, বিনয় ও সদ্ব্যবহারে অনন্য, অগ্রজ-সমকালীন ও অনুজ বিবেচনায় প্রাজ্ঞবান [সব বয়সের বহু মানুষকে কবিতা উৎসর্গ করেছেন এবং কবিতায় অসংখ্য মানুষের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন], সংগঠন নির্মাণে নিবেদিত এবং দেশ ও দশের কল্যাণচিন্তায় ও কর্মে উৎসর্গোকৃত প্রাণ। এক কথায়, তিনি মহৎ মানুষ, অনন্য কবি। ব্যক্তিত্বের প্রগাঢ় ছাপ পড়েছে তাঁর কবিতায়।
আদর্শনিষ্ঠ ও মহৎ চিন্তা-কর্মের কবি খুব বেশি নেই বাংলা সাহিত্যে। সেইসব বিরল কবিদের মধ্যে মল্লিক অন্যতম এবং সম্ভবত সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন, আদর্শ ও কাব্যসৃষ্টি একই সমান্তরালে ভাস্বর। স্বভাবতই দূষিত সমাজ ও অসহনীয় কাব্যসমাজ থেকে অন্তরালে, কোলাহলহীন আবহে অবস্থান নিয়ে সেই সমাজেরই সংস্কারে মগ্ন থেকেছেন কবি। প্রচারবিমুখ এই কবির প্রচুর রচনা তাই এখনও অপ্রকাশিত, তাঁর কাব্যপ্রতিভা মিডিয়ায় আজও উপেক্ষিত, পাঠক জানেই না তাঁর কবিতার স্বাদ-গন্ধযুক্ত রতœভাণ্ডার সম্পর্কে। কিন্তু বাংলা কবিতার গোপনতম স্রোতকে নীরবে নির্ভতে বেগবান করে গেলেন এই কবি। আর আস্থা ও বিশ্বাসের স্বতন্ত্র কাব্যধারা সৃষ্টিতে রেখে গেলেন অসামান্য অবদান। মল্লিকের দানের উত্তরাধিকার বহমান ও বেগবান হওয়ার ওপরই নির্ভর করছে বাংলা ভাষায় আস্থাপূর্ণ সাহিত্যের বিজয়।
মতিউর রহমান মল্লিকের কবিতা আস্থাপূর্ণ সাহিত্যের বিজয়_ড. ফজলুল হক তুহিন

Recent Comments